ফরিদপুরের শত বছরের পুরোনো দুর্গোৎসব

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের গোহাইলবাড়ি গ্রামের কর বাড়ির দুর্গাপূজার মণ্ডপ। ছবি: প্রথম আলো
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের গোহাইলবাড়ি গ্রামের কর বাড়ির দুর্গাপূজার মণ্ডপ। ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম গোহাইলবাড়ি। গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ আর দশটি ছায়াঘেরা গ্রামের মতো হলেও এই গ্রামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর কারণ হলো দুর্গাপূজা। এ গ্রামের কর বাড়ির দুর্গাপূজা এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো পারিবারিক পূজা হিসেবে পরিচিত ও সমাদৃত।

গোহাইলবাড়ি গ্রামটির অতীত বেশ সমৃদ্ধ তিনটি বনেদি পরিবারের বসবাসের কারণে। তবে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দুটি বনেদি পরিবারের সদস্যরা দেশান্তরিত হলে অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসে গ্রামটি। দেশভাগ এ গ্রামের মানুষের মাঝ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয়। তারপরও গ্রামটির ঐতিহ্য হিসেবে আজও টিকে রয়েছে কর বাড়ির পারিবারিক দুর্গাপূজা।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পার্বতী চরণ কুণ্ডু, রঘুনাথ কর ও হীরা লাল কর্মকার—এই তিন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উত্তরসূরিরা পাল্লা দিয়ে শুরু করেন দুর্গোৎসব। তবে প্রথমে এ অঞ্চলে দুর্গাপূজার আয়োজন করে কুণ্ডু পরিবার। এরপর এ প্রতিযোগিতায় যোগ দেয় কর ও কর্মকার পরিবার।

তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কুণ্ডু পরিবারের সদস্যরা ভারতে চলে গেলে তাঁদের পারিবারিক পূজা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর কর্মকারদের পূজাটিও বন্ধ হয়ে যায়। তবে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে আজও অব্যাহত রয়েছে কর পরিবারের পারিবারিক পূজা।

কত পুরোনো কর বাড়ির এ দুর্গাপূজা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেন না। তবে সবাই একবাক্যে বলেন, বহু পুরোনো। কেউ বলেন, শের শাহের (১৪৮৬-১৫৪৫) সময়কাল থেকে শুরু হয়েছে এ পূজা। আবার কারও অভিমত, অধুনা মাগুরার মহম্মদপুর এলাকার রাজা সিতারাম রায়ের (১৬৫৮-১৭১৪) রাজত্বের সময় থেকে শুরু হয় এ পূজা। জনশ্রুতি যে সময়ের কথা বলে, তার প্রথমটি সত্য হলে দ্বিতীয়টির চেয়ে অন্তত ২০০ বছর এগিয়ে যায়। দ্বিতীয়টি সত্য হলে এ পূজার বয়স মোটামুটিভাবে দাঁড়ায় আড়াই শ বছর।
তবে নিছক জনশ্রুতি ছাড়া এসব বক্তব্যের সমর্থনে কোনো দালিলিক কিংবা নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গোহাইলবাড়ির এক কিলোমিটার পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে গেছে মধুমতী নদী। মধুমতী নদীর ওপারেই মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা। ওই মহম্মদপুরেই রাজত্ব করতেন রাজা সিতারাম রায়। ওই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিতারাম রাজার গোচারণভূমি ছিল গোহাইলবাড়ি। গোচারণভূমি থেকেই হয়তো পরে এ গ্রামের নামকরণ হয়ে যায় ‘গোহাইলবাড়ি’।

বোয়ালমারী পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শ্যামল কুমার সাহা বলেন, বোয়ালমারীসহ এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো দুর্গাপূজা কর বাড়ির এ পারিবারিক পূজাটি। তবে এটি কত পুরোনো, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁর নেই।

বর্তমানে এ পূজার আয়োজন করেন পবিত্র কর, প্রদীপ কর, দেবাশীষ কর, সরোজ কর ও শুশান্ত করসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। প্রদীপ কর বলেন, ‘আমরা সাত প্রজন্ম ধরে পারিবারিক উদ্যোগে এ পূজা করছি। দুর্গাপূজার পাশাপাশি শ্যামা, মনসা ও সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়।’

এ পূজার প্রতিমা নির্মাণ করেন পাশের লংকারচর গ্রামের প্রভঞ্জন কুমার সরকার। প্রায় দেড় শ বছর ধরে এ পরিবারটি পারিবারিক পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি কাঠামোর মধ্যে (দুর্গা, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক) প্রতিমা নির্মাণ করছে। এ বছরও তার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি।