নিম্নাঞ্চলটি আজ অভিজাত জনপদ

মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার মূল ফটক। সোমবারের ছবি।  প্রথম আলো
মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার মূল ফটক। সোমবারের ছবি। প্রথম আলো

বছরের বেশির ভাগ সময় পুরো এলাকা ডুবে থাকত গভীর পানিতে। বর্ষায় রাত-দিন দল বেঁধে মাছ ধরতেন জেলেরা। শুষ্ক মৌসুমে পানি কমলে নিচু জমিতে হতো ধানের চাষ। কিন্তু গত তিন দশকে আমূল বদলে গেছে পুরো এলাকার চেহারা। এটি এখন রাজধানীর বেশ পরিচিত ‘মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকা’। আদাবর থানাসংলগ্ন শেখেরটেকের পাশেই এই অভিজাত আবাসনটি ভরে উঠেছে সারি সারি বহুতল ভবনে।

গত সোমবার আবাসিক এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, জলাভূমির চিহ্নমাত্র নেই। উঁচু ভবনে ছেয়ে গেছে চারপাশ। প্রশস্ত সড়ক, ঝাঁ-চকচকে ফুটপাত বদলে দিয়েছে এলাকার দৃশ্যপট। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনসুরাবাদ হাউজিং লিমিটেড নামের একটি আবাসন কোম্পানি এখানে নিচু জমি কিনে ভরাট করে প্লট তৈরি করে বিক্রি করে।

সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘১৯৯২ সালে যখন এখানে জমি কিনি, তখন এই এলাকায় মানুষের বসতি দূরের কথা, রাস্তাঘাট বলতে কিছু ছিল না। এখন এটি মধ্যবিত্তের অভিজাত আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।’ তিনি জানান, আদবর আর দারুস সালামের দিকে দুটি টেক (জলাভূমির মধ্যে উঁচু জায়গা) ছিল। সেখানে কয়েক ঘর বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরাই ছিলেন এসব জমির প্রকৃত মালিক। জমি বিক্রি করে তাঁরা কে কোথায় চলে গেছেন, এখনকার বাসিন্দারা তা জানেন না।

যাতায়াতের কোনো রাস্তা না থাকায় নব্বইয়ের দশকে জমির দাম ছিল খুব কম। এসব প্লটে এক কাঠা জমি এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন ভালো সড়ক যোগাযোগ তৈরি হওয়ায় জায়গার দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। স্থানীয় বাসিন্দা একটি বেসরকারি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাজেদুর রহমান বলেন, এখন মনসুরাবাদে খালি প্লট নেই বললেই চলে। মূল সড়কঘেঁষা প্লটে প্রতি কাঠার দাম এক কোটি টাকা। আর ভেতরের দিকে সংযোগ সড়কের আশপাশে প্রতি কাঠা জমি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকায়।

মনসুরাবাদ হাউজিং লিমিটেড সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি তিন কাঠা আয়তনের ৪০০ প্লট নিয়ে গড়ে উঠেছে এই আবাসন প্রকল্পটি। মোট আয়তন প্রায় ৬০ বিঘা। এ, বি, সি ও ডি—এই চারটি ব্লকে ভাগ করা। মাঝ বরাবর ৪০ ফুট প্রশস্ত মূল সড়ক। এর এক প্রান্ত বায়তুল আমান ও শেখেরটেক হাউজিং হয়ে জাপান গার্ডেন সিটির সামনে শ্যামলী রিং রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আর অপর প্রান্ত গৈদারটেক সেতু হয়ে গাবতলী মাজার রোডে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ভেতরে চলাচলের জন্য রয়েছে ৩০ ফুট প্রশস্ত ১২টি সংযোগ সড়ক।

যোগাযোগব্যবস্থা সম্পর্কে প্লট ও ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন ২০০২ সালে বাড়ি করি, তখন এই এলাকায় কোনো পাকা সড়ক ছিল না। ১৫-১৬ বছরের মধ্যে এলাকার রাস্তা এত উন্নত হবে, তা আমাদের ভাবনাতেও ছিল না।’ শেরেবাংলা নগরকে বর্তমানে ঢাকার দ্বিতীয় কেন্দ্রস্থল বলা যায়। যানজট না থাকলে এখান থেকে ১০ মিনিটে শেরেবাংলা নগর যাওয়া যায়। এ ছাড়া মনসুরাবাদ থেকে গৈদারটেক সেতু হয়ে ১০ মিনিটে ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ গাবতলী যাওয়া যায়। শহরের মূল কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগও বেশ সহজসাধ্য।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এলাকাটিতে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ ছিল একটি—শ্যামলী রিং রোড। কিন্তু সম্প্রতি গৈদারটেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মিত হওয়ায় এলাকায় এখন দ্বিমুখী যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে সহজেই মাজার রোড হয়ে গাবতলী, বৃহত্তর মিরপুরসহ ঢাকার উত্তর প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যাচ্ছে। সহজ যোগাযোগব্যবস্থা আবাসনের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় নতুন গতি এনে দিয়েছে। তবে এতে কিছু সমস্যাও জুটেছে।

গৈদারটেকে সেতু নির্মাণ ও মূল সড়কটি ভালো হওয়ায় আবাসনের ভেতরের প্রধান সড়ক দিয়ে রাত-দিন দ্রুতগতিতে নানা ধরনের যানবাহন যাতায়াত করছে। বাসিন্দাদের অনেকে বলেছেন, দ্রুতগতির এসব যানবাহনের কারণে আবাসিক এলাকার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। তা ছাড়া হাইড্রোলিক হর্নের আওয়াজে রাতে সড়কের কাছাকাছি ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে।

মনসুরাবাদ আবাসিক এলাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনই নির্মাণ করছে বিভিন্ন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি ভবন তৈরি করেছে লতিফ রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন বলেন, এখানে ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর খাল ভরাট করে আবাসিক এলাকাটি করা হয়েছে। তাঁরা প্লটের মালিকদের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কয়েকটি প্লট একত্র করে ৮ থেকে ১২ তলা পর্যন্ত ভবন তৈরি করেছেন। এসব ভবনে প্রায় ৪০০ ফ্ল্যাট রয়েছে।

ভেতরে ঘুরে দেখা গেল এলাকাটি বেশ পরিচ্ছন্ন। ভেতরের সড়কগুলো ভালো; পানি, বিদ্যুতের সমস্যা নেই। চারজন নিরাপত্তারক্ষী রাতে এলাকার নিরাপত্তা দেখভাল করেন। তবে এলাকাবাসীর অভিযোগ, আবাসিকের পাশ দিয়ে প্রবাহিত কল্যাণপুর খাল নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ায় মশার সমস্যা স্থায়ী রূপ পেয়েছে। তবে কোনো মাঠ বা উদ্যান নেই, গাছপালাও কম। সে কারণে নেই সবুজের স্নিগ্ধতা।