ঢাকার তিন সড়কে মৃত্যু বেশি

অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক হাবিবুর রহমান। গত ১ আগস্ট হোটেল র‍্যাডিসনের সামনে দিয়ে রাস্তায় হাঁটার সময় পেছন থেকে একটি পিকআপ ভ্যান তাঁকে সজোরে ধাক্কা দেয়। হাবিবুরের ভাতিজা মাহফুজুর প্রথম আলোকে বলেন, মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে তাঁর চাচা এখন স্মৃতিভ্রষ্ট। 

শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী ইসরাত জাহান। গত ২৬ মার্চ তার মামা লিটনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে খিলক্ষেতে বাসায় ফিরছিল। মোটরসাইকেলটি বিমানবন্দর সড়কের জোয়ারসাহারা এলাকায় পৌঁছালে পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দেওয়ায় ঘটনাস্থলে ইসরাত মারা যায়। তার বাবা জহিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মামলা করলেও চালক জামিনে বেরিয়ে গেছেন। পুলিশ এখনো কোনো প্রতিবেদন দেয়নি।

ঢাকা মহানগরের থানা ও ঢাকার আদালতের নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগরের মধ্যে বিমানবন্দর সড়কে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোক মারা যাচ্ছেন। ঢাকার বিমানবন্দর থানাসহ ছয়টি থানার তথ্য বলছে, বিমানবন্দর সড়কে বিগত তিন বছর নয় মাসে (২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত) সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৬১ জন। আহত হয়েছেন ২৬ জন।

বিমানবন্দর সড়কের পর ঢাকার পল্টন মোড় থেকে বিজয় সরণি মোড় পর্যন্ত ভিআইপি সড়কে বিগত তিন বছর চার মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১১৭ জন। এ ছাড়া গত তিন বছর নয় মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সায়েদাবাদ জনপথ মোড় থেকে রফিকুল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মোড় পর্যন্ত এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭৬ জন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ঢাকার বিগত এক বছর নয় মাসের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ২২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। এই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২১৫ জন। এর মধ্যে পথচারী নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী নিহত হওয়ার সংখ্যা ৩৯ ভাগ। ২০১৭ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ২৬৭টি। মারা গেছেন ২৮০ জন। এর মধ্যে পথচারী ১৩০ জন। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৬ ভাগ পথচারী।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ  প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার রাস্তাগুলো পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়নি। অধিকাংশ সড়কে আবার সংযোগ সড়ক আছে। আবার গণপরিবহন সুশৃঙ্খল নয়। যাত্রী তোলার জন্য পর্যাপ্ত বাস স্টপেজ নেই। চালকেরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। সড়কগুলো পথচারীবান্ধব নয়। যত্রতত্র পথচারী পার হচ্ছেন। এসব কারণে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যাত্রীদেরও দোষ কোনো অংশে কম নয়। রাস্তার মাঝখানে নামার জন্য চলন্ত বাসের চালকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। যত্রতত্র নামাতে বাধ্য করেন। ঢাকার বিমানবন্দর সড়কেও আমরা সেটা দেখেছি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের যাত্রীদের সচেতন হতে হবে।’

বিমানবন্দর সড়কে কেন বেশি দুর্ঘটনা
খিলক্ষেত থানায় দুই বছর কর্মরত ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) সহিদুর রহমান। বর্তমানে গাজীপুরের টঙ্গী (পশ্চিম) থানার পরিদর্শক সহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দর সড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই পথচারী। তাঁর সামনে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটতে তিনি দেখেছেন। পথচারীরা দৌড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় এই দুর্ঘটনা হচ্ছে।

ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, বনানী, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব এবং খিলক্ষেত থানার দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিমানবন্দর সড়কের বিমানবন্দর গোলচত্বর, কাওলা পদচারী–সেতু, হোটেল র‍্যাডিসন, মুনমুন কাবাব গেট, গলফ ক্লাব, শেওড়াবাজার বাস স্টপেজ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, এমইএস যাত্রীছাউনি, জিয়া কলোনি গেট, লোটাস কামাল টাওয়ারসহ ২৩টি স্থানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। গত তিন বছরে এ সড়কের বিমানবন্দর গোলচত্বরেই নিহত হয়েছেন ১০ জন।

ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মানিকদীর বাসিন্দা অহিদ মিয়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় রিকশা চালান অন্তত ১৫ বছর ধরে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হোটেল র‍্যাডিসনের সামনে একটি ফুটওভারব্রিজ (পদচারী–সেতু) আছে। কিন্তু লোকে সেখান দিয়ে না গিয়ে রাস্তা দিয়ে পার হন। অহিদ মিয়া জানান, বিমানবন্দর সড়কের শেওড়াবাজার থেকে এমইএস পর্যন্ত সড়কে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

বিমানবন্দর সড়কের হোটেল র‍্যাডিসন ব্লুর সামনে গত ২৯ জুলাই বাসের জন্য অপেক্ষারত দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। ঘটনাস্থলে মারা যায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী।

শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র ফারহান গত ৮ আগস্ট প্রথম আলোকে বলে, ঝুঁকি নিয়ে তারা স্কুলে আসা-যাওয়া করে থাকে। প্রায়ই এমইএস মোড়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

বিমানবন্দর সড়কে সরেজমিনে দেখা গেছে, বনানী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের ফাঁক দিয়ে যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। একইভাবে ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন এমইএস যাত্রীছাউনির সামনের সড়কবিভাজকের ফাঁকা স্থান দিয়ে পথচারীদের পার হতে দেখা যায়। বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় পদচারী–সেতু থাকলেও বেশির ভাগ পথচারী চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন।

এই এলাকায় যানজট কম থাকায় গাড়ির গতি বেশি থাকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেশির ভাগ সময় রাস্তা ফাঁকা থাকায় চালকেরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পথচারীরা যাতে আর বিমানবন্দর সড়কের ডিভাইডার (সড়কবিভাজক) দিয়ে পার হতে না পারেন, সে জন্য সড়কবিভাজকের ওপর আরও দুই থেকে আড়াই ফুট বেড়া দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক
যাত্রাবাড়ী থানার তথ্য বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ পদচারী-সেতুর পূর্ব-পশ্চিম পাশ, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ীর চৌরাস্তা মোড়, সাদ্দাম মার্কেট এলাকা, সায়েদাবাদের জনপথ মোড়, হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর, মাতুয়াইল মেডিকেল মোড়, টোটাল সিএনজির সামনে, রিগাল সিএনজির সামনে, যাত্রাবাড়ীর নিউ নিপুর ইন্টারন্যাশনাল গোলাপবাগের সামনে, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ওয়ান ব্যাংকের সামনে ও বাদশা মিয়া রোডে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

ভিআইপি সড়ক
পল্টন মোড় থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত ভিআইপি সড়কের প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ মোড়, বাংলামোটর মোড়, কারওয়ান বাজার এলাকা, ফার্মগেট মোড়, বিজয় সরণি মোড়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ  প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িচাপায়, গাড়ির ধাক্কায় বেশির ভাগ পথচারী নিহত হচ্ছেন। ঢাকার সড়কবিভাজক দিয়ে লোকে যাতে পার হতে না পারেন, সে জন্য বিভাজকগুলোয় কোনো ফাঁক রাখা যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণ পদচারী–সেতু তৈরি করতে হবে। পথচারী সচেতন হয়ে যদি যত্রতত্র না পার হন, তাহলে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। চালকেরা রাস্তায় যাতে বেপরোয়া গাড়ি চালাতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।