দারিদ্র্য তাঁদের লড়াইয়ের প্রেরণা

নিজের লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছেন মো. সুজন মিয়া। ছবি: আবদুস সালাম
নিজের লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছেন মো. সুজন মিয়া। ছবি: আবদুস সালাম

শৈশব থেকেই দারিদ্র্য আর অবহেলা ছিল মো. সুজন মিয়ার নিত্যসঙ্গী। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন দিনমজুর। গ্রামে সুজনের পরিবারকে অবজ্ঞাভরে বলা হতো, ‘অশিক্ষিতের বাড়ি’। মানুষের অবজ্ঞা ও নিজেদের দারিদ্র্যই সুজনকে লড়াই করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সেই তথাকথিত ‘অশিক্ষিতের বাড়ির’ উঠোন থেকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখেছেন সুজন। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজনে ‘অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা ২০১৮’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে নিজের লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছিলেন সুজন মিয়া। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আজ মঙ্গলবার সকালে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই ট্রাস্ট থেকে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন বা এখনো পড়ছেন—এমন অনেকেই আজ নিজেদের সংগ্রামের গল্প শোনান অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের। তাঁদেরই একজন হলেন সুজন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করেছে যাঁরা, তাঁরা মানবদরদি সাংবাদিক। গোবর থেকে তুলে এনে আজকের এই মঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন আমাদের।’

অনুষ্ঠানে লড়াইয়ের গল্প ছিল আরও। অদম্য মেধাবীদের জবানিতে সেগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। অবজ্ঞা, দারিদ্র্যই তাঁদের অনুপ্রেরণা। তার জোরেই নিজেদের প্রমাণ করার সাহস পেয়েছেন তাঁরা। প্রতিটি মুহূর্তে এসেছে বাধা-বিপত্তি। কিন্তু মেধার জোরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থামায়নি ওঁরা। তাঁদের পাশে আছে প্রথম আলো ট্রাস্ট ও ব্র্যাক ব্যাংক। এই অদম্য মেধাবীদের আরেকটু সাহস জোগাতেই মঙ্গলবারের সংবর্ধনার আয়োজন।

অদম্য মেধাবীদের লড়াকু জীবনের গল্প শোনার পাশাপাশি উপস্থিত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জানান নিজেদের সফলতার পেছনের গল্প। ছবি: আবদুস সালাম
অদম্য মেধাবীদের লড়াকু জীবনের গল্প শোনার পাশাপাশি উপস্থিত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জানান নিজেদের সফলতার পেছনের গল্প। ছবি: আবদুস সালাম

রহমত আলী ৩৭ তম বিসিএস পরীক্ষায় পররাষ্ট্র বিভাগে প্রথম হয়েছেন। তিনি বলেন, এ সমাজে কেউ এগোতে চাইলে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরা হয়। কিন্তু এই নিরুৎসাহকে শক্তি হিসেবে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। একসময় দেখা যাবে এ দেশে সবাই মেধাবী। তখন অদম্য কথাটি থাকবে না। কারণ সেই বাধা আসবে না।

আজকের অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে এ রকম অনেক মেধাবী লুকিয়ে আছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের তুলে আনতে হবে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। সবাই বলছে, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। সে জন্য আমাদের শিক্ষিত মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এই অদম্য মেধাবীরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

অনুষ্ঠানের আরেক অতিথি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী বলেন, ‘সমাজের অন্যরা এগিয়ে এলে আরও মেধাবীরা উঠে আসবে। বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলাদেশ। এই পথ চলা যেন শেষ না হয়। আমরা এগোলে, দেশ এগোবে।’

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘এঁদের সংগ্রাম শুনলে মন ভরে যায়। আমরা আরও উৎসাহ পাই, উদ্দীপ্ত হই বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে। ১৯৯৯ সাল থেকেই প্রথম আলো মেধাবীদের পাশে দাঁড়ায়। ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তা শুরু হয়। এরপরে যুক্ত হয় ব্র্যাক ব্যাংক। এ ছাড়া অ্যাসিড দগ্ধদের পাশেও প্রথম আলো তার কর্মীদের একদিনের বেতন দিয়ে সহায়তা শুরু করে। আমরা শুধু লিখব না, সমাজের জন্য ভালো কিছু করতেও চেষ্টা করব।’

শুধু পড়াশোনাতেই নয়, প্রয়োজনে চাকরির ক্ষেত্রেও পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন প্রথম আলো ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘এই মেধাবীরাই আমাদের উৎসাহ দেয়। তোমরা স্বপ্ন দেখতে ভুলবে না। সব স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হলেও কিছু তো হবে। আমাদের চেয়েও অনেক বড় হবা। চাকরির বেলাতেও তোমাদের পাশে সঙ্গে থাকব আমরা। সততা ও নিষ্ঠা থাকতে হবে।’

ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অদম্য মেধাবী ২০১৮ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে অতিথিদের সঙ্গে অদম্য মেধাবীরা। ১২৭ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন, ফার্মগেট, ঢাকা, ২৩ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম
ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অদম্য মেধাবী ২০১৮ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে অতিথিদের সঙ্গে অদম্য মেধাবীরা। ১২৭ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তন, ফার্মগেট, ঢাকা, ২৩ অক্টোবর। ছবি: আবদুস সালাম

অদম্য মেধাবীদের লড়াকু জীবনের গল্প শোনার পাশাপাশি উপস্থিত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জানান নিজেদের সফলতার পেছনের গল্প। চলচ্চিত্র অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী জানান, তিনি নিজেও সংগ্রাম করে এসেছেন। অভিনেত্রী জয়া আহসান অদম্য মেধাবীদের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। আরও বক্তব্য দেন নাগরিক টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুন নূর তুষার, চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ ও অভিনেত্রী মেহজাবিন চৌধুরী।

প্রথম আলো ট্রাস্ট চলতি বছর অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে ১২৭ জন অদম্য মেধাবীকে সংবর্ধনা দিয়েছে। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগিতায় ৯৪ জন, ব্যবসায়ী মিতুলী মাহবুবের সহায়তায় ২০ জন, প্রবাসী শাহেদ ইকবালের সহায়তায় ১০ জন ও এসডিসির সহায়তায় ৩ জনকে দেওয়া হয় সংবর্ধনা।

ব্র্যাক ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিআরও চৌধুরী আখতার আসিফ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সাফল্য আসবেই। কিন্তু ভালো মানুষ হওয়া দরকার। এই মেধাবীরা সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলবে।’

বার্জার পেইন্ট বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান রুপালী চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। তেমনি এই মেধাবীদেরও কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’

প্রথম আলো ট্রাস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৭ সালে অদম্য মেধাবীদের শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া শুরু করে। ব্র্যাক ব্যাংক ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা বৃত্তির জন্য আর্থিক দায়িত্ব নিয়ে এই উদ্যোগে যুক্ত হয়। এ পর্যন্ত এই তহবিল থেকে ৮৪০ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ট্রাস্টের মাধ্যমে শিক্ষা সহায়তা দিচ্ছে।

আজকের অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক ও প্রথম আলো ট্রাস্টের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আজিজা আহমেদ। অনুষ্ঠান শুরুতে ছিল তরঙ্গমীর পরিবেশনায় পূজা সেনগুপ্তের নাচ। জাদুকর রাজীব বসাক খুলে দিয়েছিলেন তাঁর জাদুর ঝোলা। এ ছাড়া সংগীত পরিবেশন করেন মিনার রহমান।

এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রথম আলো ট্রাস্টের সদস্য তাজিন আহমেদ, জাহেদা ইস্পাহানি, ব্র্যাক ব্যাংকের হেড অব কমিউনিকেশন ও সার্ভিস কোয়ালিটি জারা জাবীন মাহবুব, সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ূম এবং রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অধ্যক্ষ ও প্রথম আলো ট্রাস্টের স্কুল ‘আলোর পাঠশালা’র শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন।