এক ভাইয়ের লাশ সড়কে, আরেক ভাই নিখোঁজ

আবুল হোসেন
আবুল হোসেন
>

• নারায়ণগঞ্জে চার লাশ
• গ্রামবাসী মনে করছেন, নিহত আবুলের ভাই পুলিশের হাতে আটক আছেন।
• পুলিশ এ ঘটনা অস্বীকার করে আসছে।
• চারজনের সঙ্গে ধরে নেওয়া লিটনের এখনো খোঁজ নেই।
• আবুল নিহত হওয়ার পর পরিবার আতঙ্কে।
• তাঁর অন্য ভাইদেরও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
• আবুল হোসেন ও আবুল কালামকে ১৮ অক্টোবর ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ পঞ্চমীঘাট গ্রামের দোকানে আবুল হোসেনের বাড়ি কোনটা জিজ্ঞেস করতেই লোকজনের পাল্টা প্রশ্ন, ‘পুলিশের “ক্রসফায়ারে” মরছে, ওই আবুল?’

এলাকার সবাই জানেন, দুই ভাই আবুল হোসেন ও আবুল কালামকে ১৮ অক্টোবর ধরে নিয়েছিল পুলিশ। দুই দিন পর আবুল হোসেনের গুলিবিদ্ধ লাশ ঢাকা বাইপাস সড়কের ওপর পাওয়া যায়। তখন পুলিশ বলেছিল, দুই দল ডাকাতের ভাগাভাগি নিয়ে কোন্দলে আবুল নিহত হন। তিনিও ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। আরেক ভাই আবুল কালাম এখনো বাড়ি ফেরেননি, তিনি তখন থেকেই পুলিশের হাতেই আটক বলে দাবি স্বজন ও গ্রামবাসীর। তবে পুলিশ এসব অস্বীকার করে আসছে।

অবশ্য দুই ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে গতকাল শুক্রবার রাতে ফোন করে প্রথম আলোকে জানানো হয়, আবুল কালাম বাড়ি ফিরেছেন।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত চার খুনের সঙ্গেও আবুল হোসেন হত্যার যুক্ততা রয়েছে। আবুলকে ধরে নেওয়ার পরদিন ১৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার পুরিন্দা পশ্চিমপাড়া গ্রামের একটি বাড়ি থেকে বাসচালক ফারুক হোসেনসহ চারজনকে ধরে নেওয়া হয়। ধরে নেওয়ার সময় ওই বাড়িতে আবুলের স্ত্রী পারভীন আক্তার উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে নিহত ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা বেগম বলেন, সেদিন পারভীন বাসায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই অস্ত্রধারী লোকজন বাসায় ঢুকে পড়ে। বাসায় এসে পারভীন বলেছিলেন, তাঁর স্বামী ফারুকের বন্ধু। তাঁর স্বামীকে পুলিশে ধরেছে, এ কারণে সাহায্য চাইতে ফারুকের কাছে এসেছেন। তাসলিমার ধারণা, আবুলের স্ত্রী পারভীনকে কৌশলে সেখানে পাঠানো হয়েছিল।

দুদিন পরে (২১ অক্টোবর) ধরে নেওয়া তিনজনসহ চারজনের লাশ পুরিন্দা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারে পাওয়া যায়। ফারুকের বাড়ি থেকে ধরে নেওয়া লিটনের এখনো কোনো খোঁজ নেই।

এই চারজনের লাশ পাওয়ার আগের দিন (২০ অক্টোবর) আবুলের লাশ পাওয়া যায় ঢাকা বাইপাস সড়কের টেংরারটেক এলাকায়। ওই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ডাকাতি করা মালামালের ভাগাভাগি নিয়ে দুই দল ডাকাতের মধ্যে গোলাগুলি হয়।

আবুলের বাড়ি সোনারগাঁয়ের পঞ্চমীঘাট এলাকায়। তবে দেড় বছর ধরে তিনি স্ত্রী-সন্তানসহ পুরিন্দা বাজারে লোকচাঁন মোল্লার বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকছিলেন। সেখান থেকেই তাঁকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। গতকাল পুরিন্দা বাজার এলাকার বাড়িতে গিয়ে কথা বলার জন্য পারভীনকে পাওয়া যায়নি।

পুরিন্দা বাজার থেকে আবুলের ভাই কালামের খোঁজে যাওয়া হয় সোনারগাঁয়ের পঞ্চমীঘাট গ্রামে। গ্রামবাসী সবাই জানেন, এই দুই ভাইকে পুলিশ ধরেছিল। আবুল ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন, কালাম এখনো আটক । গ্রামবাসী জানান, আবুলেরা ছয় ভাই চার বোন। ভাইয়েরা সবাই শ্রমজীবী। তবে আবুল এর আগেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধের মামলাও রয়েছে বলে তাঁরা জানেন। তবে আবুল খুনের পরে তাঁর পরিবার আতঙ্কে রয়েছে। তাঁর অন্য ভাইদেরও নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

সোনারগাঁয়ের পঞ্চমীঘাটের গ্রামের বাড়িতে পাওয়া গেল আবুলের বড় ভাই আবু সাঈদকে। অটোরিকশাচালক সাঈদ বলেন, আবুল কালামও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। ওই দিন ভোররাতে তিনি অটোরিকশা নিয়ে বের হলে পুলিশ তাঁকে আটক করে। কোত্থেকে তাঁকে ধরা হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পরিবারের কারও কাছে। আবুলকে ধরার পরদিন পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় তিনি পরিবারের কাছে সাত হাজার টাকা চেয়ে ফোন করেন। আবুল কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভালো আছি।’

আবু সাঈদের সঙ্গে যখন এসব কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে তাঁদের আরেক ভাই ইব্রাহিমের স্ত্রী হালিমা বেগমসহ গ্রামের কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠসহ বেশ কয়েকজন ভিড় করেন। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, আবুল হোসেন ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হয়েছেন বলেই সবাই জানেন।

সাঈদ বলেন, এর পরদিনই আবুল হোসেন খুন হওয়ার খবর পান তাঁরা। এক ভাইয়ের মৃত্যুর পর আরেক ভাই আবুল কালামের জীবন নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তাঁরা। গত রবি ও সোমবার তাঁরা রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে কালামের কোনো খোঁজ জানতে ব্যর্থ হন। এরপর মঙ্গলবার তাঁদের ভাই ইব্রাহিম, তাঁর মেয়ে, স্থানীয় কাশেম মেম্বার, আবুল কালাম যাঁর অটোরিকশা চালাতেন তাঁর মালিক জসীমউদ্দীন, আবুল কালামের স্ত্রী, শ্যালকসহ ৭-৮ জন রূপগঞ্জ থানায় যান। ওই দিন পুলিশ কালামের বিষয়ে একটু নমনীয় হয়। থানায় একটি সাদা কাগজে তাঁদের স্বাক্ষর নিয়ে কালামের সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি ফেরত দেওয়া হয়। অটোরিকশার চাবির সঙ্গে নয় শ টাকাও তাঁদের দেয় পুলিশ। তখন তাঁরা কালামকে ছাড়তে বললে পুলিশের একজন বলেন, এখন কালামকে ছাড়লে ঝামেলা হতে পারে। দুই শর্তে কালামকে ছাড়া হবে বলে তারা জানায়। প্রথমত কালামকে আটকের বিষয়ে কাউকে কিছু বলা যাবে না, নিহত আবুল যে কালামের ভাই, সেটিও গোপন রাখতে হবে।

তবে রূপগঞ্জ থানার ওসি মনিরুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবুল হোসেনকে পুলিশ আটক বা গ্রেপ্তার করেনি। আর তাঁর কোনো ভাইও পুলিশের হাতে আটক নেই।