চট্টগ্রাম কারাগারে যেন অনিয়মই নিয়ম

  • চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল গ্রেপ্তার
  • জেলার গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই মুখ খুলছেন
  • জেলারের নেতৃত্বে মাসে ২ কোটি টাকা বাঁটোয়ারা হতো
  • মাসোহারা পৌঁছে দেওয়া হতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে
ভৈরবে মাদক ও টাকাসহ গ্রেপ্তার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস।
ভৈরবে মাদক ও টাকাসহ গ্রেপ্তার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস।

থাকা–খাওয়া, সাক্ষাৎ, হাসপাতালে ভর্তি—সবকিছুতেই টাকা দিতে হতো। অনিয়মই যেন নিয়ম চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ও আটক বন্দীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

কারাগার সূত্র জানায়, প্রতি মাসে গড়ে ২ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা হতো জেলারের নেতৃত্বে। মাসোহারা পৌঁছে দেওয়া হতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে। ওই সূত্রমতে, মাসে ৭৫ লাখ টাকা আসে সাক্ষাৎ–বাণিজ্য থেকে। এ ছাড়া বন্দী কেনাবেচায় ৮০ লাখ টাকা, হাসপাতালে ভর্তি থেকে ২০ লাখ, অন্যান্য খাত থেকে আসে আরও ২৫ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেকেই এখন মুখ খুলছেন, বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য দিচ্ছেন। ভৈরব রেলওয়ে থানা-পুলিশ ৪৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ১২ বোতল ফেনসিডিল, স্ত্রী, শ্যালক ও নিজের নামে করা আড়াই কোটি টাকার এফডিআরের কাগজপত্র এবং ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার চেকসহ গত শুক্রবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ‘বিজয় এক্সপ্রেসে’ চড়ে চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন।

কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, এই টাকাগুলো সম্ভবত বন্দীদের কাছ থেকে উৎকোচ হিসেবে নেওয়া। এ ঘটনায় ভৈরব থানায় মাদক ও অর্থ পাচার আইনে সোহেলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। তিনি এখন কিশোরগঞ্জ কারাগারে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। এই আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা আজ সোমবার কিশোরগঞ্জ আদালতে।

ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর সোহেল জানিয়েছেন, এসব টাকা চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাকারা-পরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিক ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) প্রশান্ত কুমার বণিককে মাসোহারা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। আগামী ১ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে জেলার সম্মেলন রয়েছে। সেখানে তাঁদের টাকাগুলো দেবেন।

তবে ওই দুই কর্মকর্তা সোহেলের কাছ থেকে মাসোহারা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সোহেল মাদকাসক্ত থাকায় অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। পার্থ গোপাল বণিক গতকাল তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, অফিসে অনিয়মিত, আদেশ না মানাসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে বারবার সতর্ক করা হলেও শুনতেন না সোহেল রানা। তাঁকে ডেকে এনে পাঁচবার সতর্ক করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মহাকারাপরিদর্শককে (আইজি প্রিজন) অবহিত করা হয়েছিল। সোহেলের ভয়ে ভুক্তভোগীরা (কারারক্ষী, বন্দী) কেউ মুখ খুলতেন না। আর প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সবকিছু অবহিত করা হতো। সোহেল কাউকে পরোয়া করতেন না।

মারধর, দুর্ব্যবহার, টাকা আদায়

গতকাল চট্টগ্রাম কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহের ধোপাউড়ার মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত আলী বিশ্বাসের ছেলে সোহেল। তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০১ সালে ডেপুটি জেলার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ২০১৫ সালে চুয়াডাঙ্গা কারাগারে একজন বৈদ্যুতিক কারিগরকে মারধরের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়।

মাসে ২ কোটি টাকা বাঁটোয়ারা তাঁর নেতৃত্বে। মাসোহারা পেতেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

মারধর ছাড়াও কারারক্ষী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ আছে সোহেলের বিরুদ্ধে। গতকাল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ জন কারারক্ষীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা অভিযোগ করেন, বাড়তি টাকা না দিলে দায়িত্ব বণ্টন, ছুটি বা বাসা বরাদ্দ দিতেন না সোহেল রানা। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেন না। বন্দীদের কাছ থেকেও টাকা আদায়ে বাধ্য করতেন।

২০০৯ সালে ভারপ্রাপ্ত জেলার হিসেবে সোহেল চট্টগ্রাম কারাগারে আসেন। সেই সময় বাড়তি টাকা নেওয়ায় বন্দীরা কারাগারে বিদ্রোহ করেছিলেন। তিন মাসের মাথায় তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে তিনি চট্টগ্রাম কারাগারে জেলার হিসেবে যোগ দেন। এক মাস আগে কারাগারের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গুলি করে মারার হুমকি দেন সোহেল রানা। বিষয়টি স্বীকার করে ওই কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলের দাপট দেখিয়ে হুমকি দেন সোহেল রানা। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে বিষয়টি জানিয়েছেন।

কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপমহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ইতিহাসে কোনো জেলার এভাবে গ্রেপ্তার হননি। সোহেলের বিরুদ্ধে আগেভাগে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলে এত দূর অগ্রসর হতে পারতেন না।

কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে ৯ হাজার ৪৫২ জন বন্দী রয়েছেন। ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮৫০ জনের হলেও গত মে মাস থেকে বন্দীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ধারণক্ষমতার পাঁচ গুণের বেশি বন্দী হওয়ায় থাকার জায়গা নিয়ে বাণিজ্য মেতে ওঠে কারা কর্তৃপক্ষ। কোনো বন্দী প্রথম দিন আসার পর আমদানি ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। প্রথমে সিট বরাদ্দের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। প্রতি মাসে নেওয়া হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।

কারাগারের কয়েদি মো. জামাল (কেস টেবিলের চিফ রাইটার), মো. জসিম ও মো. জিল্লুরের মাধ্যমে বন্দীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে জেলার সোহেলের বিরুদ্ধে। তাঁরা তিনজনই বন্দীদের কেনাবেচা করতেন। টাকা না দিলে টয়লেটের পাশে কিংবা বারান্দায় থাকতে দেওয়া হতো বন্দীদের।

নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলীর এক বাসিন্দা এ মাসের শুরুতে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাঁর ভাই জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভাই কারাগারে যাওয়ার পর তাঁদের কাছে ফোন করা হয় টাকার জন্য। ভাইকে ভালো জায়গায় রাখার জন্য প্রথমে ৫ হাজার টাকা দেন। পরে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে দেন। টাকা না দিলে মারধর করার হুমকি দেওয়া হয়।

সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া হাটহাজারীর মো. ইউসুফ জানান, গত মার্চে কারাগারের আমদানি ওয়ার্ড থেকে তাঁদের চারজনকে কয়েদিরা জেলারের কাছ থেকে কিনে নেন ২০ হাজার টাকায়। পরে কয়েদি জামাল, জিল্লুর তাঁদের কাছ থেকে আরও ২ হাজার টাকা করে বাড়তি দাবি করেন। এরপর তাঁদের যমুনা ওয়ার্ডে রাখা হয়। যাঁরা টাকা দিতে পারেন না, তাঁদের মারধর করা হয়।

রেহাই পেতেন না কেউ

আট বছর আগে সাতক্ষীরা কারাগারে ভারপ্রাপ্ত কারাধ্যক্ষের (জেলার) দায়িত্ব থাকাকালে বন্দীদের ১২ লাখ টাকা তছরুপ করেছিলেন গ্রেপ্তার হওয়া জেলার সোহেল। টাকা বুঝিয়ে দিতে বলায় সাতক্ষীরা কারাগারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক নুরনবী ভূঁইয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বিভাগীয় তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় কারা অধিদপ্তর সোহেলের পাঁচ বছরের বার্ষিক প্রণোদনা (ইনক্রিমেন্ট) বন্ধ রাখে। পরে আপিল করা হলে তা তিন বছর রাখা হয়। ঘটনার শিকার নুরনবী বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দীদের ক্যাশের ১২ লাখ টাকা তছরুপ করায় হিসাব চাওয়া হয়েছিল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটান।

২০১২ সালে খাগড়াছড়ি কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেলার থাকাকালীন সোহেলের বিরুদ্ধে করা বিভাগীয় একটি মামলার তদন্ত করেছিলেন ঢাকা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি গোলাম হায়দার। পরে তাঁকে পদাবনতি দিয়ে ডেপুটি জেলার করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কারা অধিদপ্তরে গোলাম হায়দারকে মারধর করেন সোহেল। এ ঘটনায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তের পর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আপিল করে চাকরি ফিরে পান সোহেল।

তদন্ত কমিটি গঠন

ফেনসিডিল, টাকা, চেকসহ গ্রেপ্তারের ঘটনা তদন্তে কারা কর্তৃপক্ষ গতকাল রোববার বরিশাল বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক ছগির মিয়াকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক কামাল হোসেন ও খুলনা করাগারে জেলার জান্নাতুল ফরহাদ।

কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন প্রথম আলোকে বলেন, কমিটিকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।