ধর্মঘটে পোড়া মবিল ও আইনের শাসন

৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে গাড়ি চালানোর কারণে এক মাইক্রোবাস চালকের মুখে পোড়া মবিল মেখে দেন আন্দোলনকারী শ্রমিকেরা। ঠাকুরগাঁও শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায়।  ছবি: মজিবর রহমান
৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে গাড়ি চালানোর কারণে এক মাইক্রোবাস চালকের মুখে পোড়া মবিল মেখে দেন আন্দোলনকারী শ্রমিকেরা। ঠাকুরগাঁও শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ছবি: মজিবর রহমান

গতকাল সোমবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবির অসুস্থ শিশুটি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারে। মানিকগঞ্জের ঘিওরের বাসিন্দা রমজান আলী রিকশায় ভেঙে ভেঙে হলেও তাকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পেরেছেন। কিন্তু মৌলভীবাজারের বড়লেখার অজমীর গ্রামের প্রবাসী কুটন মিয়ার সাত দিনের অসুস্থ শিশুটি মারা গেল সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা বেআইনি ধর্মঘটের প্রথম দিনে ধর্মঘটি শ্রমিকদের নৈরাজ্যের বলি হয়ে, যে সংগঠনটির কার্যকরী সভাপতি সরকারেরই একজন মন্ত্রী, শাজাহান খান।

পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, বড়লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শিশুটিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হচ্ছিল সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু ধর্মঘটি পরিবহনশ্রমিকেরা অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেন এবং চালককে মারধর করে গাড়ির চাবি নিয়ে যান। দেড় ঘণ্টা পর শ্রমিকেরা চাবি দিলেও শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি। অ্যাম্বুলেন্সেই তার জীবনাবসান ঘটে।

এটি মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড
হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘটেরও কিছু নিয়মকানুন থাকে। রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকদের বহনকারী যানবাহনকে বরাবর হরতাল–অবরোধ–ধর্মঘটের বাইরে রাখা হয়। স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল থেকে হাল আমল পর্যন্ত যখনই বিরোধী দল বা অন্য কোনো সংগঠন হরতাল, অবরোধ বা ধর্মঘটের কর্মসূচি দিয়েছে এসব পরিবহনকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত রোববার ও গতকাল পরিবহন ধর্মঘটে কাউকেই ছাড় দেওয়া হয়নি। এমনকি রিকশা, প্রাইভেট কার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যানবাহনও তাদের সহিংসতার শিকার হয়েছে। ধর্মঘটি শ্রমিকদের পেছনে যেহেতু মন্ত্রী আছেন, তাই তাঁরা আইনকানুন, সভ্যতার তোয়াক্কা করেননি। তাঁরা মাইক্রোবাসচালকের মুখে পোড়া মবিল মেখে দিয়েছেন, কলেজের ছাত্রীদের পোশাকেও পোড়া মবিল লাগিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন।

পরিবহন মালিকদের সংগঠনের নেতা ও মন্ত্রী মসিউর রহমান বলেছেন, মালিকেরা ধর্মঘট করছেন না। শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করায় যানবাহন বন্ধ আছে। কিন্তু যে মন্ত্রীর সংগঠন এই ধর্মঘট করছে, তিনি কিছু বলছেন না। এটাও রহস্যজনক। তাঁর নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন বলছে, তারা কর্মবিরতি পালন করেছে, ধর্মঘট নয়।

তাহলে রাস্তায় নৈরাজ্য কেন? কেনই–বা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসচালকের গালে পোড়া মবিল মেখে দেওয়া হলো? কেন কলেজছাত্রীকে অপমান করা হলো? গত দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমদানি–রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হলে যেতে পারেননি। এসব অঘটন ও ক্ষতি সত্ত্বেও সরকারের মন্ত্রীরা নিশ্চুপ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চুপ। তাহলে আইনের শাসন কোথায়? সরকার কোথায়?

যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো একজন মন্ত্রী কি কোনো শ্রমিক সংগঠনের প্রধান হতে পারেন? সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় মন্ত্রীর শপথ গ্রহণের বিষয়ে লেখা আছে, ‘আমি আইন অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রী পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব, আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।’

এখানে শাজাহান খান ‘অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব’ বলে যে শপথ নিয়েছেন, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি পদে থেকে সরকারের প্রণীত আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডেকে সেই শপথ ভঙ্গ করেছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, যে আইনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগঠন ধর্মঘট পালন করল, সেই আইন প্রণয়নপ্রক্রিয়ায় মন্ত্রী ও সাংসদ হিসেবে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছেন। কোনো পর্যায়ে আপত্তি করেননি। এমনকি আইনটি পর্যালোচনায় যে সাত সদস্যের কমিটি হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য হিসেবে সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সংসদে পাঠানো বিলের খসড়ায় সইও করেছেন। তাহলে এখন এই ধর্মঘট কেন?

সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে সরকারের কোনো আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন শুধু বেআইনি নয়, ঔদ্ধত্যও বটে। শ্রমি কসংগঠনের নেতা হিসেবে ধর্মঘট ডাকলে মন্ত্রিত্ব ছেড়েই তাঁর সেটি করা উচিত।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কথায় কথায় জনগণকে আইনের সবক দেন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে কঠোর হাতে বিরোধী দলের ‘ষড়যন্ত্র’ মোকাবিলা করার কথা বলেন। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, দুই দিন ধরে পরিবহন ধর্মঘটের নামে সরকারের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র একজন মন্ত্রী করলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনোই ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। এ নিয়ে মন্ত্রীদের কথাবার্তায় প্রচুর গরমিল আছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ধর্মঘট বেআইনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, শ্রমিকেরা আইনটি না বুঝে ধর্মঘট ডেকেছেন। সে ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রীর উচিত তাঁর সহকর্মীকে আইনটির মমার্থ বোঝানো। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান সংসদে এটি সংশোধনের সুযোগ নেই; পরবর্তী সংসদে বিবেচনা করা যেতে পারে। সড়কের ওপর যে সড়কমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো।

বিরোধী দল কোথাও সমাবেশ ডাকলে সরকারের পুলিশ বাহিনী আগের রাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে পাইকারি হারে নেতা-কর্মীদের আটক করে, বিরোধী দল ঢাকায় কর্মসূচি নিলে জননিরাপত্তার নামে শহরের সব প্রবেশমুখে যানবাহনে তল্লাশি চালায়। কিন্তু যখন ধর্মঘটের নামে অ্যাম্বুলেন্স আটকে অসুস্থ শিশুকে হত্যা করা হলো, প্রাইভেট কারের চালকের মুখে ও কলেজছাত্রীর পোশাকে পোড়া মবিল মেখে দেওয়া হলো, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পূর্ণ নিষ্পৃহ ও নিষ্ক্রিয় থাকল। সড়ক পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালনের নামে প্রাইভেট কারের চালকদের মুখে পোড়া মবিল মেখে দিল, অথচ মন্ত্রী কাম পরিবহন শ্রমিক নেতা নির্বিকার। ‘কোনো মন্তব্য নয়।’ তিনি যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, তাঁর সামনে তাঁর গাড়ির চালকের মুখ যদি কোনো শ্রমিক পোড়া মবিল দিয়ে লেপ্টে দিতেন, তিনি কীভাবে নিতেন?

সরকার উন্নয়নের রোল মডেলের গল্প শোনাচ্ছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল যে এখনো সব মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছেনি, সেটাই উঠে এসেছে গত বুধবার ঢাকা চেম্বারের বাণিজ্য সম্মেলনে ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞদের কথায়। তাঁরা বলেছেন, অবকাঠামো প্রকল্প থেকে রাজনৈতিক দলের অর্থায়ন বা ভাগ নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করত হবে। এই ভাগ নেওয়ার একটা হিসাব পাওয়া গেল প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনের প্রতিবেদনে। প্রতিটি গণপরিবহন থেকে দৈনিক ৭০ টাকা করে ৬ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়, যা বছরে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা।

এখানেই শ্রমিক সংগঠনের পদ ও ধর্মঘটের আসল রহস্য। নানা অজুহাতে যে সাধারণ শ্রমিকদের ধর্মঘটে নামানো হয়, তাঁরা এ থেকে কোনো সুবিধা পান না। সুবিধা পান তথাকথিত মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এ কারণেই ‘জলের’ মন্ত্রী সড়কে আধিপত্য বিস্তার করেন।

সরকারের মন্ত্রীরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গলা ফাটান। কিন্তু গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলাকারীদের ধরার ক্ষেত্রে আইনের শাসন দেখা যায় না। আইনের শাসন দেখা যায় না স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী হেলমেটধারীদের ধরার ক্ষেত্রেও। অবৈধ ধর্মঘট আহ্বানকারীদের বিরুদ্ধেও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেন না।

তাহলে আইনের শাসনের রং যে পোড়া মবিলের চেয়ে উৎকৃষ্ট, বলি কী করে?