কার্যকর সংসদে ছিল জবাবদিহির অভাব

>
  •  ২০১৪ সালের নির্বাচনে গঠিত হয় দশম সংসদ
  • বিএনপিসহ অনেক দল নির্বাচন বর্জন করে
  • ১৫৩ জন সাংসদ নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
  • মোট ২৩টি অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৪১০টি
  • বিরোধীদের প্রশংসায় ভেসেছে সরকার
  • আইন প্রণয়নে ভূমিকা ছিল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’
  • বাইরে থেকেও সমালোচনার কেন্দ্রে বিএনপি

শেষ হলো সরকার ও বিরোধী দলের যুগলবন্দীর দশম জাতীয় সংসদের অধিবেশন। কাগজ–কলমে কার্যকর হলেও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দশম সংসদ কতটুকু কার্যকর ছিল, সে প্রশ্ন রয়ে গেছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মপরিচয়ের সংকটে ছিল বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। অধিবেশনের শেষ দিন পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী দলের নজিরবিহীন সখ্য অটুট ছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ। বিএনপিসহ অনেক দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। ১৫৩ জন সাংসদ নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জাতীয় পার্টি (জাপা) সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে। একই সঙ্গে দলটি ছিল সরকারেরও শরিক। এরশাদ নিজে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, আরও তিনজন নেতা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। বিএনপি শুরু থেকেই জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে আসছে।

দশম সংসদে মোট ২৩টি অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল ৪১০ টি। সংসদ নেতা শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৩৩৮ কার্যদিবস। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ছিলেন ২৪২ কার্যদিবস।

দশম সংসদ কার্যকর উল্লেখ করে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর এবং সংসদীয় কমিটিতে বিরোধী দলের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এসব প্রক্রিয়াতেই নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়।

এই সংসদে ১৯৩টি আইন পাস হয়। শেষ সময়ে এসে আইন প্রণয়ের হিড়িক পড়ে। এর মধ্যে ১০ কার্যদিবসের ২২ তম অধিবেশনে ১৮টি এবং ৮ কার্যদিবসের শেষ অধিবেশনে ১৯টি আইন পাস হয়। তবে আইন প্রণয়নের কাজে সাংসদের ভূমিকা ছিল ‘হ্যাঁ’ ‘না’–তে সীমিত। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সাংসদ মিলিয়ে ঘুরেফিরে ৯-১০ জন সাংসদ ছাড়া অন্যরা আইন প্রণয়নের আলোচনায় (বাজেটসংক্রান্ত আইন বাদে) অংশ নেননি।

এই সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ফৌজদারি অপরাধ করলেও আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না—এমন বিধান রেখে আইন হয়। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষা সনদের স্বীকৃতিসংক্রান্ত আইন পাস হয় এই সংসদে। অন্যদিকে সম্পাদক পরিষদ, দেশি–বিদেশি বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ–আপত্তি উপেক্ষা করে পাস হয় বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয় এই সংসদে। পরে আদালত এই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে।

দশম সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিকে নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল কড়া সমালোচনা করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায় দেখা গেছে, দশম সংসদের প্রথম বছরে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা মোট ৫৩১ বার বিএনপির সমালোচনা করেন।

এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ, ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা, হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয় সংসদে।

সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে খুব একটা বিতর্ক দেখা যায়নি। বিরোধী দল অনেক সময় প্রশংসায় ভাসিয়েছে সরকার ও সরকারপ্রধানকে। কখনো কখনো সরকারের ভাবমূর্তি নিয়েও চিন্তিত দেখা গেছে তাঁদের। প্রতিটি অধিবেশনে সংসদ নেতা ‘গঠনমূলক ভূমিকার জন্য’ বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

বিরোধী দলের চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে সংসদের বিরোধী দলগুলোর আচরণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি একটি ইতিবাচক রাজনীতি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে কোনো নীতিনির্ধারণী বিষয়ে শক্ত সমালোচনা বা অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। এই সময়ে বিরোধী দল তিনবার সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। তবে একাধিকবার বিরোধী দল নিজেরাই নিজেদের পরিচয়সংকটের কথা তুলে ধরেছে। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের পরিচয় স্পষ্ট করার দাবি তুলে বলেছিলেন, ‘আমরা সরকারি দল না বিরোধী দল—সাংবাদিকেরা তা জানতে চান।’

সংসদীয় কার্যক্রম নিয়ে গবেষণা করে থাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একটি বিতর্কিত প্রেক্ষাপটে এই সংসদ তৈরি হয়, বিরোধী দল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মপরিচয়সংকটে ছিল। যদিও শেষ দিকে দলটি কিছু আইন নিয়ে কথা বলেছে। তাঁর মতে, সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি বন্ধ হয়েছে। সরকারি দল সন্তুষ্টি পেতে পারে যে তারা মেয়াদ শেষ করেছে, অনেক আইন পাস হয়েছে। কিন্তু সব মিলে সংসদের মৌলিক ভূমিকা ও জনগণের পক্ষ থেকে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার কাজ এই সংসদে কতটুকু হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন, আলোচনা ও গবেষণা চলবে দীর্ঘদিন।