বিএনপি আরেকটু দেখতে চায়

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপে সুনির্দিষ্ট কোনো ‘অর্জন’ না হওয়ায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বড় শরিক বিএনপি। তবু দলটির নেতারা এখনই হাল ছেড়ে দিতে চান না। তাঁরা আরেকটু দেখতে চাইছেন, নির্বাচনের আগমুহূর্তে শুরু হওয়া এই সংলাপের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট সাত দফা দাবি সরকারপ্রধানের কাছে উপস্থাপন করেছে। এর যুক্তিও তুলে ধরেছে। এখন বল সরকারের কোর্টে। দাবি মানা না–মানা সরকারের ব্যাপার। ঐক্যফ্রন্ট দাবি আদায়ে কর্মসূচি নিয়ে এগোবে। সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে নির্বিঘ্নে জনসভা করতে দেওয়ার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা কতটা রক্ষা হয়, তাঁরা দেখবেন। ৬ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের জনসভা হবে। এই কর্মসূচি বড় আকারে করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট।

গত বৃহস্পতিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের সংলাপে বিএনপির ছয় নেতা অংশ নেন। তাঁদের দুজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা বলছেন, সংলাপের ফলাফল এমনই হবে, তা জেনেও তাঁরা সংলাপে গেছেন। কারণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁরা অনেক দিন ধরেই সংলাপ চেয়ে আসছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে, নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকট যে ধীরে ধীরে ব্যক্তি, দল ও পরিবারবিশেষের শত্রুতায় পর্যবসিত হয়েছে, তার অবসান। সরকারপক্ষ সংলাপের এই আহ্বান আগাগোড়া নাকচ করে দিলেও কৃত্রিম বা কৌশল যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সংলাপ হয়েছে। এটাকে একটা ‘অর্জন’ হিসেবে দেখতে চান তাঁরা।
অবশ্য গতকাল শুক্রবার সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংলাপে মানুষের মনে যে আশাবাদ জেগে উঠেছিল, সংলাপ শেষে সেই আশার মুকুল ঝরতে শুরু করেছে।’

বিএনপির সূত্র জানায়, সংলাপের পর গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা পর্যালোচনা করেন। জানা গেছে, বিএনপির নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, সাড়ে তিন ঘণ্টার আলোচনায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, সংসদ বাতিল, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনের সময় সেনা মোতায়েন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, খালেদা জিয়ার জামিন, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা-প্রায় সব বিষয়ই উঠেছে। দুই পক্ষে সামনাসামনি পাল্টাপাল্টি যুক্তি এসেছে। তবে সরকারের মনোভাবের কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাননি তাঁরা। আবার সরকার কোনো কিছুই একেবারে নাকচ করে দেয়নি।
যদিও সংলাপে অংশ নেওয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গতরাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি এমনই যে আসলে এর মূল্যায়ন করাটা দুরূহ।’
বৃহস্পিতবার গণভবন থেকে বেরিয়ে আপনি বলেছেন সংলাপে সন্তুষ্ট না, কেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। আমরা আমাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করেছি। কিন্তু যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে কোনো দাবির ব্যাপারেই সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফল পাইনি।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সে সাত দফার ভিত্তিতে আমরা আলোচনা করতে চেয়েছি। দু-একটা দাবির সম্পর্কে তাঁরা কথা বলেছেন। কিন্তু মূল যে বিষয় নিরপেক্ষ সরকার, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, অবাধ নির্বাচন—এ বিষয়গুলোতে তাঁরা ইতিবাচক কিছু বলেননি। এ ব্যাপারে তাঁরা আবার কথা বলতে চেয়েছেন, আলোচনা করতে চেয়েছেন।’
এত সময় কি হাতে আছে, জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সময় তো নেই। নির্বাচন এসে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণা হবে। আমরা বলেছি, তাহলে তফসিল পিছিয়ে দেওয়া হোক। তাঁরা বলেছেন, এটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। এখন তাঁরা আরও দলকে ডেকেছেন। আমরা দেখব, তারপর কী বলেন।’

বিএনপির বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উচ্চপর্যায়ের এক নেতা বলেন, সংলাপে যাওয়ার আগে তাঁরা প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলেন যে যাতে কোনো ফাঁদে না পড়েন এবং সেখানে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়। নেতাদের অনেকের ধারণা ছিল, উত্তেজিত করে আলোচনা নষ্ট করে পরে এর দায় ফেলা হবে ঐক্যফ্রন্টের ওপর। এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে ফোন করে পরে তা ফাঁস করিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া হয়েছিল, এবারের সংলাপেও তেমন কিছুর আশঙ্কা করেছিলেন কেউ কেউ। এ কারণে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা আলোচনায় সংযত ছিলেন। অনেক অপ্রিয় সত্য বলেননি, অনেক প্রশ্নের জবাব থাকলেও দেননি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংলাপে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় ছিলেন জাসদের একজন নেতা। ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ধারণা ছিল, তাঁকে দিয়েই বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করাতে চেয়েছে সরকার। তিনি খালেদা জিয়া, জঙ্গি, ২১ আগস্ট, তারেক রহমানসহ বিভিন্ন বিষয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।

বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ অবস্থায় সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বা ফলপ্রসূ হয়নি, এখনই এ কথা বলে দেওয়াটা সমীচীন হবে না। নেতারা মনে করছেন, সংলাপ নিয়ে এখনই নেতিবাচক মন্তব্য করলে এর দায়ভার ফেলানো হবে বিএনপির ওপর। তাই দলের নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।
সংলাপে উপস্থিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংলাপ শুরুর একপর্যায়ে বিএনপির অন্তত দুজন নেতা কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ‘গায়েবি’ মামলার বিষয়টি তোলেন। খালেদা জিয়ার মামলার বিষয়টি আদালতের বিষয় বলে প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে যান। এ সময় প্রতিনিধিদলে থাকা বিএনপির একজন নেতা বলেন, খালেদা জিয়া উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলো না, বিভিন্ন কৌশল করে আটকে রাখা হলো। বিএনপির একজন নেতা আলোচনার স্বার্থে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।

ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের এখন উপলদ্ধি হচ্ছে, সরকারকে চাপ দিতে না পারলে কিছুই অর্জিত হবে না। এ জন্য তাঁদের পরবর্তী চেষ্টা হবে মানুষকে রাস্তায় নামানো।
ঐক্যফ্রন্ট এখন কী করবে? এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখব। আমরা জনসভা করছি, জনগণের কাছে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে আরও কর্মসূচি দেব।’
বিএনপির সূত্র জানায়, সংলাপের বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা পর্যালোচনা করেন। জানতে চাইলে সংলাপে অংশ নেওয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গতরাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি এমনই যে আসলে এর মূল্যায়ন করা যায় না। মূল্যায়ন করাটা দুরূহ।’