আ.লীগের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে আঞ্চলিক দল

রাঙামাটিতে এত দিন আঞ্চলিক দল, বিশেষ করে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) যাকে সমর্থন দিত, তারাই সংসদ নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকত। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচন থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। জেএসএস সেবার প্রথমবারের মতো নির্বাচন করে তৃতীয় হয়। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তিনবারের সাংসদ দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে জেএসএসের ঊষাতন তালুকদার নির্বাচিত হন। এবারও বড় দুই দলের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে জেএসএসসহ আঞ্চলিক দলগুলো।

জেএসএসের আধিপত্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বড় মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার জেএসএস অপর আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে এনেছে। তবে বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মনোভাবকে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।

আওয়ামী লীগে একক প্রার্থী থাকলেও বিএনপিতে রয়েছে বিভক্তি। প্রার্থীও একাধিক। আবার জেএসএসের সঙ্গে বিএনপির অলিখিত ঐক্যের সমীকরণ উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে রাঙামাটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হন। ওই সময় জেএসএসের সমর্থন ছিল দলটির ওপর। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঞ্চলিক দলগুলোর টানাপোড়েন দেখা দেয়। তখন জেএসএস বিএনপির প্রার্থী মনি স্বপন দেওয়ানকে সমর্থন দেয় এবং তিনি জয়ী হন।

২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও সাড়ে ৫৬ শতাংশ ভোট পড়েছিল। অনেক বিএনপি সমর্থক তখন ভোটকেন্দ্র গিয়েছিলেন এবং তাঁদের ভোট জেএসএসের বাক্সে গেছে বলে মনে করা হয়। ওই নির্বাচনে ঊষাতন তালুকদার ৯৬ হাজার ২৩৭ এবং দীপংকর তালুকদার ৭৭ হাজার ৩৮৫ ভোট পেয়েছিলেন।

 আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার এগিয়ে আছেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জেলা পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে গণসংযোগ করছেন দীপংকর। অন্য কাউকে তেমন দেখা যাচ্ছে না।

তবে দলের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে জেএসএসের সঙ্গে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, পার্বত্য চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করা, পার্বত্য ভূমি কমিশনের আইন সংসদে পাস হলেও কাজ শুরু না হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হতে পারে। তবে আসন পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে দীপংকর তালুকদার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গতবার প্রায় ১৯ হাজার ভোটে তিনি জেএসএসের ঊষাতন তালুকদারের কাছে হেরে যান।

দীপংকর তালুকদার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গত নির্বাচনে অস্ত্রের মুখে ৫৩টি কেন্দ্র তারা দখল করে জিতেছে। এবার তা করতে দেওয়া হবে না। আঞ্চলিক দলগুলোর চলমান সংঘাত নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।

জানা যায়, গত নির্বাচনের পর থেকে এখানে জেএসএসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো নয়। গত বছর দুর্বৃত্তদের হামলায় এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত এবং কয়েকজন আহত হন। এরপর ব্যক্তিগত ও নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে গত বছর রাঙামাটি সদর, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়িসহ বেশ কিছু এলাকা থেকে প্রায় দেড় হাজার পাহাড়ি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। এ জন্য আওয়ামী লীগ অবশ্য জেএসএসের হুমকিকে দায়ী করেন।

দীপংকর তালুকদার বলেন, জেএসএস এই হামলা করেছে। এবার আর হুমকিতে কাজ হবে না। আগে কিছু উদাসীনতা থাকলেও এখন আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ।

জেএসএসের সহসভাপতি সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, পার্বত্য চুক্তির পর জেলা আওয়ামী লীগ জেএসএসকে নির্বাচন করতে বাধ্য করেছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেএসএসের কোনো বিরোধ নেই।

 জেএসএস ও অন্যান্য আঞ্চলিক দল

রাঙামাটিতে জেএসএসের প্রভাব বরাবরই বেশি। তবে এই আঞ্চলিক দলটি এখনো নির্বাচনের বিষয়ে মুখ খুলছে না। সময় হলে বলা হবে নীতিতে মুখে কুলুপ এঁটেছেন সাংসদ এবং দলের অন্য নেতারা। তবে দলটি ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্যে বর্তমান সাংসদ ঊষাতন তালুকদার ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমার নাম শোনা যাচ্ছে।

সাংসদ ঊষাতন তালুকদার বলেন, জেএসএস এখনো নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তফসিল ঘোষণার পর দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষে সবাই কাজ করবে।

জেএসএস নির্বাচন না করলেও নির্বাচনী মাঠে দলটির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কাজ করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলটি বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করতে পারে বলেও মনে করছেন দীপংকর তালুকদার। তিনি বলেন, গতবার জেএসএস বিএনপির ১২ হাজার ভোট পেয়েছে।

আরেক আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফের রাঙামাটিতে কোনো নড়াচড়া নেই। তাদের নজর মূলত খাগড়াছড়ি আসনের দিকে। ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। তবে রাঙামাটি আসনে প্রার্থী বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ নেওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে ইউপিডিএফ কিছুটা সমস্যায় থাকলেও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও কাউখালী উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় ইউপিডিএফের আধিপত্য রয়েছে। চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে এসব উপজেলায় অনেক নেতা-কর্মী মারা যান।

আবার নানিয়ারচর সদর ও বাঘাইছড়ি উপজেলার এক ইউনিয়নে জনসংহতি সমিতির (এমএন–লারমা) আধিপত্য রয়েছে। ২০১৪ সালে দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সুধাসিন্ধু খীসা নির্বাচন করেছিলেন। এবার নিজেরা অংশ না নিলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের সখ্য হওয়ার সম্ভাবনা শোনা যাচ্ছে।

জেএসএস রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে দলের মধ্যে এখনো আলোচনা হয়নি। তবে নিজেদের মধ্যে প্রার্থী দেওয়া না হলে অন্য কোনো শরিক দলের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেব।’

 বিএনপি বিভক্ত

বিএনপি দুই গ্রুপে বিভক্ত। এক পক্ষে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহধর্মবিষয়ক সম্পাদক দীপেন দেওয়ান এবং অন্য পক্ষে জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহ আলম। দুজনই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দীপেন দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনোনয়নপ্রত্যাশী। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। শাহ আলম বলেন, রাঙামাটি বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর জন্য মনোনয়ন চাচ্ছেন। মনোনয়ন পেলে নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে।