জীবাণু-প্রতিরোধী কাগজ উদ্ভাবন

>
ভালোর সাথে আলোর পথে
ভালোর সাথে আলোর পথে

*এই কাগজ খাদ্যপণ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নথিকে জীবাণুমুক্ত-রোগপ্রতিরোধী করবে
*গবেষণার নেতৃত্বে বুয়েটের শিক্ষক শফিউল আজম
*বিজ্ঞানীরা সামুদ্রিক ঝিনুক-শামুকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেছেন
*যুক্তরাষ্ট্রের দুটি, কানাডার একটি ও চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা

বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা নতুন এক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যা ব্যবহার করে কাগজে কোনো জীবাণুর আক্রমণ ও বিস্তার ঠেকানো যাবে। জীবাণু-প্রতিরোধী এই কাগজ খাদ্য বা পণ্যের মোড়ক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্বপূর্ণ নথি ও বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও এই কাগজের ব্যবহার হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও বিজ্ঞানী শফিউল আজমের নেতৃত্বে জীবাণু-প্রতিরোধী এই কাগজ উদ্ভাবিত হয়েছে। কাগজের সঙ্গে সিলভার ন্যানো কণা স্প্রে করে মিশিয়ে দেওয়ার এই প্রযুক্তির ফলাফল গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের রাসায়নিক সমিতির জার্নাল এসিএস সাসটেইনেবল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

তুলনামূলক কম দাম ও সহজলভ্য হওয়ায় বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক ও প্রকাশনার কাঁচামাল হিসেবে কাগজের ব্যবহার হয়। খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধনসামগ্রী, ওষুধপত্র প্যাকেজিংয়ের কাজে কাগজের বহুল ব্যবহার হয়। এ ছাড়া বই, ম্যাগাজিন, টাকা, অফিস ফোল্ডার, ওয়ালপেপার তৈরিতেও রয়েছে কাগজের ব্যবহার। কাগজ ও কাগজের তৈরি প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে এক দেশ থেকে বিরল প্রজাতির কোনো জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে অন্য দেশে।
বিশেষ এই কাগজ উদ্ভাবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার একটি ও চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা করছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গবেষণাটিতে আরও জড়িত ছিলেন বুয়েটের প্রভাষক নাহিদা আক্তার ও তরুণ গবেষক শফিকুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম ও গবেষক মাহবুবুর রহমান এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবারটার অধ্যাপক হংবো জেং ও চ্যান শি।

জানতে চাইলে শফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের কাগজ উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছিল। আমরা সফল হয়েছি। এটি একটি মৌলিক উদ্ভাবন। এখন এই গবেষণার ফলাফলকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আমরা কাজ করছি। এ ধরনের কাগজ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন এবং তা ব্যবহারের সম্ভাব্য খাতগুলো আমরা চিহ্নিত করছি।’

২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ওই গবেষণা হয়। গবেষণার বেশির ভাগ কাজ বুয়েটে হয়। তবে বেশ কিছু রাসায়নিক পরীক্ষা কানাডার সায়েন্স অ্যান্ড একাডেমিক রিসার্চ কাউন্সিলের ল্যাবরেটরিতে হয়েছে।

কীভাবে সম্ভব হলো
প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, জীবাণু-প্রতিরোধী কাগজ উদ্ভাবনের জন্য তাঁরা সামুদ্রিক ঝিনুক ও শামুকের একটি বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে অনুসরণ করেছেন। ঝিনুক ও শামুকের মধ্যে পলিডোপামিন নামক একটি বিশেষ যৌগের উপস্থিতি থাকে, যে কারণে এরা সমুদ্রের প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করেও পাথর ও সমুদ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে নিজেদের আটকে রাখতে পারে। একইভাবে এই গবেষণায় কাগজের মধ্যে প্রথমে পলিডোপামিন সংযোজন করা হয়েছে, যা পরে প্রতিকূল পরিবেশেও সিলভার ন্যানো কণাদের কাগজের সঙ্গে শক্তভাবে আটকে রাখতে সক্ষম হয়, যা দীর্ঘদিন এই অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাবলি অক্ষুণ্ন রাখবে।

বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন, পরীক্ষায় দেখা গেছে, বিভিন্ন মাছ ও চিংড়িতে সংক্রমিত হয়, এ ধরনের প্রায় সব জীবাণুর বিস্তার ওই কাগজ প্রতিহত করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও এই কাগজ বেশ কিছু ছত্রাকের আক্রমণ সমানভাবে প্রতিরোধ করতে পারে বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে। এই কাগজের তৈরি প্যাকেজিংয়ে মূল্যবান পণ্য, ওষুধ, খাদ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যাবে।

গবেষণাটিতে সহায়তা করেছে বুয়েট, বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞানীদের বৈশ্বিক সংগঠন দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স এবং কানাডার সায়েন্স অ্যান্ড একাডেমিক রিসার্চ কাউন্সিল।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইলিশের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ন্যানো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের উদ্ভাবন হচ্ছে। সেগুলো সেই দেশগুলোর শিল্প উৎপাদন ও পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জীবাণু-প্রতিরোধী এই কাগজ শুধু খাদ্যপণ্যের মোড়ক বা প্রকাশনার কাজে ব্যবহার হবে না, সার, কীটনাশক, রাসায়নিক দ্রব্যের মোড়ক হিসেবে এই কাগজ নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।