এলএনজি সরবরাহে বিঘ্ন সারা দেশে গ্যাস-সংকট

>* সরবরাহ শুরুর আড়াই মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো পাইপলাইনে ত্রুটি

* ত্রুটির কারণে জাতীয় গ্রিডে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে
* জাতীয় গ্রিডে গ্যাস-সংকট সৃষ্টি হওয়ায় তিতাস সিস্টেমেও প্রভাব পড়ছে
* ঢাকার অনেক এলাকায় রোববার সকাল থেকে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না

কারিগরি ত্রুটির কারণে মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ঢাকাসহ সারা দেশে নতুন করে গ্যাস-সংকট দেখা দিয়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যায় এই ত্রুটি দেখা দেয়। এতে জাতীয় গ্রিডে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।

মাত্র আড়াই মাস আগে, গত ১৮ আগস্ট থেকে পাইপলাইনে এলএনজির বাণিজ্যিক সরবরাহ শুরু হয়। এর আগেও পাইপলাইনের মধ্যেকার বিশেষ সংযোগে ত্রুটির কারণে নির্ধারিত সময়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা যায়নি। এরই মধ্যে কী ধরনের কারিগরি ত্রুটি দেখা দিল, যাতে সরবরাহই বন্ধ হয়ে গেল, এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ্‌ প্রথম আলোকে বলেন, ভাসমান টার্মিনাল ও সমুদ্র তলদেশের পাইপলাইনের মধ্যবর্তী সংযোগস্থলের হাইড্রোলিক ভালভটি অকার্যকর হয়ে গেছে। ফলে পাইপলাইনে গ্যাস আসছে না।

পেট্রোবাংলার এলএনজি সেলের সূত্র জানায়, অকার্যকর হয়ে যাওয়া হাইড্রোলিক বাল্বটি ৪০ মিটার পানির তলদেশের পাইপলাইনে স্থাপিত। বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ছাড়া এটির মেরামত সম্ভব নয়। তাই এই কাজের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিটের ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের জন্য যারা এখন মহেশখালীতে কাজ করছেন, তাঁদের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তাঁদের দিয়ে কাজ হলে কয়েক দিনের মধ্যে পুনরায় এলএনজির সরবরাহ শুরু হতে পারে। আর তা না হলে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ অানতে হবে। তাতে কত দিন লাগবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, গত ১৮ আগস্ট থেকে ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে প্রতিদিন ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছিল। ফলে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা সম্পূর্ণ গ্যাসই (দৈনিক প্রায় ২৭০ কোটি ঘনফুট) চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সরবরাহ করা সম্ভব হওয়ায় চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি কমেছিল। এখন এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবার জাতীয় গ্রিড থেকেই চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। ফলে এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ার পর গ্যাসের ঘাটতি যেটুকু কমেছিল, তা আবার বেড়েছে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশন, বাসাবাড়ি-নির্বিশেষে সব শ্রেণির গ্রাহক নতুন করে গ্যাস-সংকটে পড়েছে।

ঢাকার অনেক এলাকায় রোববার সকাল থেকেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও সেসব এলাকায় গ্যাস ছিল না। বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে বিকল্প ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ, এলপি গ্যাস, এমনকি কোথাও কোথাও জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্নার কাজ করা হয়। অনেকে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাচ্ছেন।

পুরান ঢাকায় এমনিতেই গ্যাসের সমস্যা ছিল। দুই দিন ধরে তা আরও বেড়েছে। তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, রাধিকা মোহন বসাক লেন ও আশপাশের এলাকা, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস ছিল না। গোয়ালনগরের বাসিন্দা তরুণ ঘোষ অভিযোগ করেন, এমনিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাস থাকে না। গত দুই দিন প্রায় একটানা গ্যাস নেই।

রাজধানীর অন্যান্য এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকট চলছে মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, রিং রোড, কল্যাণপুর, রামপুরাসহ আশপাশের এলাকায়। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের বাসিন্দা মো. লুৎফুজ্জামান বলেন, কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই রোববার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকাল ছয়টার দিকে গ্যাস এসে ঘণ্টাখানেক ছিল। কী কারণে গ্যাস নেই, তাঁরা জানতেও পারছেন না।

শ্যামলী গার্ডেন স্ট্রিটের বাসিন্দা শংকর মৈত্র টেলিফোনে জানান, গ্যাস না থাকায় রেস্তোরাঁ থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সেখানেও প্রচণ্ড ভিড়। কাটাসুর, শের শাহ্‌ সুরি রোড, কাদেরাবাদ হাউজিং, শ্যামলী ২ নম্বর রোড এলাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাস নেই।

তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশনস) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় গ্রিডে গ্যাস-সংকট সৃষ্টি হওয়ায় তিতাস সিস্টেমেও প্রভাব পড়ছে। সরবরাহ কমে গেছে।

সরকার ২০১০ সাল থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করে। শেষ পর্যন্ত এ বছরের ২৪ এপ্রিল এলএনজি মজুত ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) মহেশখালীতে আসে। তবে ওই টার্মিনাল ও সমুদ্রতলদেশের পাইপলাইনের মধ্যেকার বিশেষ সংযোগে ত্রুটির কারণে ১৮ আগস্টের আগে সরবরাহ শুরু করা যায়নি। সেই বিলম্বিত শুরুর আড়াই মাসের মধ্যে আবার এলএনজির সরবরাহে বিঘ্ন ঘটল।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৩৫০ কোটি ঘনফুট। এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ায় এই চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ হচ্ছিল। এখন তা ২৭০ কোটি ঘনফুটে নেমেছে।