বদলে যাওয়া একটি সরকারি হাসপাতাল

>

*মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যার হাসপাতাল
*মূল ভবনে ঢুকলে মনে হবে পাঁচ তারকা হাসপাতালের ছোট সংস্করণ
*পুরো হাসপাতাল ঝকঝকে-তকতকে, মেঝেতে টাইলস বসানো
*হাসপাতালে বেড়েছে রোগী, স্বাস্থ্যসেবায় স্বস্তি

জামালপুর-মেলান্দহ সড়কের পাশেই মেলান্দহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এই সরকারি হাসপাতাল দেশের অন্য উপজেলা হাসপাতাল থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। হাসপাতালটি ঝকঝকে, তকতকে। সেবা নিয়েও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় গত চার-পাঁচ মাসে এই সরকারি হাসপাতালে পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সহায়তা পেলে দেশের অন্য সরকারি হাসপাতালেও এই পরিবর্তন আনা সম্ভব।

গ্রামের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের চিকিৎসার বড় আশ্রয়স্থল উপজেলা হাসপাতাল। দেশে এ রকম হাসপাতাল আছে প্রতি উপজেলায় ১টি করে মোট ৪৯১টি। কিছু কিছু হাসপাতালে সীমানাপ্রাচীর নেই। কিছু হাসপাতালে প্রাচীর থাকলেও তা ভাঙা। হাসপাতালে গরু-ছাগল অবাধে যাতায়াত করে। দেয়ালে পানের পিক, চুনের দাগ চোখে পড়ে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ওয়ার্ডগুলোতে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রোগীর চিকিৎসা চলে। হাসপাতালজুড়ে উৎকট গন্ধ। সারা দিনে হয়তো একবার ঝাড়ু পড়ে ওয়ার্ডে। টয়লেটগুলো ভাঙা ও নোংরা থাকায় রোগী ও তাদের আত্মীয়রা সেগুলো ব্যবহার করতে চায় না। জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালের চিত্র কিছুদিন আগেও এ রকম ছিল।

১ নভেম্বর হাসপাতাল ফটক দিয়ে ঢোকার সময় একজন প্রহরী চোখে পড়ে। তিনি রিকশা, মোটরসাইকেল, ইজিবাইকসহ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সবুজ চত্বর ও ফুলবাগানও চোখে পড়ে। হাতের বাঁ দিকে নতুন একটি টিনের ছাউনি। ৫০টির মতো চেয়ার সেখানে। রোগী ও তাদের আত্মীয়রা সেখানে এসে বসেন। পাশেই টিকিট কাউন্টার। হাতের ডান দিকে টিনের ছাউনির দুটি গ্যারেজ। একটিতে থাকে অ্যাম্বুলেন্স, অন্যটিতে কিছু মোটরসাইকেল। হাসপাতালের ভেতরে অন্য কোথাও গাড়ি বা যানবাহন রাখা নিষেধ।

৫০ শয্যার হাসপাতালের মূল ভবনে ঢুকলে মনে হবে রাজধানীর পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলোর কোনো একটির ছোট সংস্করণ। সব কক্ষ, বারান্দা, ওয়ার্ড ও টয়লেটের মেঝেতে টাইলস বসানো। পুরো হাসপাতাল ঝকঝকে-তকতকে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার তাঁরা হাসপাতাল ঝাড়ু দেন, টয়লেট পরিষ্কার করেন।

একটি বেসরকারি সংস্থার মাঠকর্মী আঞ্জুমান আরা পেটে ব্যথা নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসকের উপস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। আঞ্জুমান আরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাস ছয়েক আগে ডায়রিয়ার কারণে ভর্তি হয়েছিলাম। এবার অসুস্থ হওয়ার পর এসে দেখি হাসপাতাল পাল্টে গেছে। হাসপাতাল নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া হচ্ছে। বাথরুম পরিষ্কার। অনেক স্বস্তিতে আছি।’

ভবনের নিচ তলায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. ফজলুল হকের কার্যালয়। দরজার ওপরে খেলা: ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’। হাসপাতালের এই পরিবর্তন সম্পর্কে ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ইউনাইটেড ট্রাস্ট সরকারি এই হাসপাতালের নতুন কিছু অবকাঠামো সংস্কার ও নির্মাণ করেছে। হাসপাতাল পরিষ্কার রাখা ও চিকিৎসকদের সহায়তা করার জন্য জনবল দিয়েছে। তাদের এই সহায়তায় পাল্টে গেছে হাসপাতালের বাহ্যিক চেহারা ও সেবার মান।

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ট্রাস্ট। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল তাদের। মেলান্দহ হাসপাতালের পুরোনো সব টয়লেট সংস্কার করার পাশাপাশি ছয়টি নতুন টয়লেট তৈরি করে দিয়েছে ট্রাস্ট। একটি সম্মেলনকক্ষসহ চারটি নতুন কক্ষ তৈরি করেছে। হাসপাতালে লোহার নতুন রেলিং যুক্ত হয়েছে। পুরোনো বৈদ্যুতিক ফ্যান সংস্কারসহ ২০টি নতুন ফ্যানের ব্যবস্থা করেছে। বাইরের তিনটি টিনশেড তাদেরই করা। এ ছাড়া বেশ কিছু চিকিৎসার সরঞ্জামও তারা চালুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হাসপাতালের ভেতরের রাস্তা ও চত্বর সংস্কার করেছে। ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ১৩ জন কর্মী দেওয়া হয়েছে। তাঁদের পাঁচজন চিকিৎসার কাজে সহায়তা করেন, বাকিরা নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তাঁদের বেতন দেয় ট্রাস্ট।

ইউনাইটেড ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক এ জে এম ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাস্ট শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও কমিউনিটি উন্নয়ন—এই চারটি বিষয়ে কাজ করে। নিজেদের হাসপাতাল থাকার পরও দিশারী প্রকল্প হিসেবে মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালে যুক্ত হয়েছে ট্রাস্ট। মূল লক্ষ্য গ্রামের দরিদ্র মানুষ যেন মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পায়।

মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পুরুষ ওয়ার্ড। সোমবার দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
মেলান্দহ উপজেলা হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পুরুষ ওয়ার্ড। সোমবার দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে শুরু: সরকারি হাসপাতালে ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেওয়ার কোনো বিধান ছিল না। কিন্তু যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা এমদাদ হোসেন স্থানীয় জনসাধারণ ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসাসেবায় পরিবর্তন আনেন। তিনি ঝিনাইদহ জেলা হাসপাতালে বদলি হয়ে সেখানেও একই কাজ করেছিলেন। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরকারি হাসপাতালের সেবা বাড়াতে স্থানীয় সহায়তা নেওয়ার ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন করে। এখন চৌগাছা-ঝিনাইদহ মডেল সারা দেশে চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চিকিৎসক এমদাদ হোসেন এই উদ্যোগে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৭ সালে মেলান্দহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তাব দেয় ইউনাইটেড ট্রাস্ট। পরে দুই পক্ষের সমঝোতা চুক্তি হয়। পুরো কাজটি করার জন্য হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সহায়তা গ্রুপ গঠন করা হয়। স্থানীয় পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ১৭ জন সদস্য এই গ্রুপে যুক্ত আছেন। গ্রুপের সদস্যসচিব ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মো. ফজলুল হক।

মেলান্দহ উপজেলার চেয়ারম্যান এ কে এম হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনাইটেড ট্রাস্ট এগিয়ে এসেছে, এলাকার জনপ্রতিনিধিরা হাসপাতালের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।’ এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগেই হাসপাতালের মান ধরে রাখবে বলে তিনি মনে করেন।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে ও অন্তর্বিভাগে রোগী আগের চেয়ে বেড়েছে। আশপাশের তিনটি উপজেলার রোগীও এখানে নিয়মিত আসছে। রোগীর আস্থা বেড়েছে বলেই তারা এখানে বেশি আসছে বলে মনে করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের পরিসংখ্যান কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভর্তি ও জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া রোগী ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ২৭২ ও ৫ হাজার ৩৯৪ জন। ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাসে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৪২৬ ও ৫ হাজার ৬০৫। গত বছরের চেয়ে এবার হাসপাতালের আয়ও বেড়েছে। একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, সহায়ক স্বাস্থ্যকর্মী থাকায় রোগী দেখায় শৃঙ্খলা এসেছে। এখন রোগীকে বেশি সময় দেওয়া যাচ্ছে।

নতুন শক্তি: হাসপাতালে টাঙানো একটি ব্যানার নজর কাড়ে। তাতে লেখা: ‘মাতৃমৃত্যুমুক্ত উপজেলা’। গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত কারণে এই উপজেলায় একজন মায়েরও মৃত্যু হবে না এই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই কাজে সার্বিক সহায়তা ও সমর্থন আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।

উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে সব গর্ভবতীর নিবন্ধন করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গত দুই-তিন মাসে আটটি ইউনিয়নের মা সমাবেশ হয়েছে। সেখানে গর্ভবতী মায়ের করণীয় সম্পর্কে স্বাস্থ্যকর্মীরা বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়েছেন। এসব সমাবেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। গর্ভবতী আছেন এমন বাড়িতে সবুজ ও লাল রঙের পতাকা টাঙানো হচ্ছে। সবুজ পতাকার অর্থ, এই বাড়িতে সাত মাসের কম সময়ের গর্ভবতী মা আছেন। লাল পতাকার অর্থ, এই বাড়িতে সাত মাসের বেশি সময়ের একজন গর্ভবতী মা আছেন। এই পতাকা দিয়ে প্রতিবেশীকেও সচেতন ও সতর্ক করা হচ্ছে। যেন জরুরি প্রয়োজনে তাঁরা এগিয়ে আসেন। মায়ের যেন মৃত্যু না হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মাতৃমৃত্যুমুক্ত উপজেলা ঘোষণার উদ্যোগ দেশে এটাই প্রথম। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি উপজেলায় ধনী মানুষ আছেন। তাঁরা চাইলে সরকারের চিকিৎসাসেবায় সহায়তা করতে পারেন। সরকার এ ধরনের সহায়তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। মেলান্দহের পরিবর্তনের কথা জেনে আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা করেন।