শিকলে বন্দী শাকিলের জীবন

মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলে শাকিলের পায়ে শিকল বাঁধছেন মা। এরপর তিনি কাজে যাবেন। গতকাল উত্তর শাহজাহানপুরে।  ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলে শাকিলের পায়ে শিকল বাঁধছেন মা। এরপর তিনি কাজে যাবেন। গতকাল উত্তর শাহজাহানপুরে। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ফুটপাতে পথচারী পারাপারের সাইনবোর্ডের খুঁটি ও পায়ের সঙ্গে লাগানো শিকলই শাকিলের সারা দিনের সঙ্গী। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় যা-ই হোক, মানুষের বাসার কাজ থেকে মা না ফেরা পর্যন্ত শাকিলকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সন্ধ্যা বা রাতে মা শিকলের তালা খুলে ১৯ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে বাসায় ফেরেন।

এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে শাকিলের এই বন্দিজীবন। খিলগাঁও উড়ালসড়ক থেকে নামার পর উত্তর শাহজাহানপুর কবরস্থানের কাছে গেলে দেখা মিলবে তাঁর। উল্টো পথের ফুটপাতের ফল বিক্রেতা আবদুল হালিমসহ দু-একজনের সঙ্গে শাকিলের সখ্য গড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে তাঁরা কিছু খাবার বা পানি দেন। এর বাইরে অনার্স পড়ুয়া ফাতেমা-তুজ জোহরা কয়েক দিন ধরে শাকিলকে কখনো বনরুটি, কখনো বিস্কুট এনে খাওয়ান। কখনো শাকিলের মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দেখা যায়, খুঁটি ধরে শাকিল একা দাঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত আচরণ করছেন। তাঁর পাশে ছোট একটি লাঠি হাতে আরেক মানসিক প্রতিবন্ধী নারী বসে আছেন। ব্যস্ত সড়কে রিকশা-গাড়ি ছুটে চলেছে। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ব্যস্ত পথচারী। শাকিলের দিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়! অথবা এটা তো প্রতিদিনের দৃশ্য, তাই খুব একটা গায়ে লাগাচ্ছেন না কেউ। তবে ফাতেমা-তুজ জোহরার সঙ্গে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রীর উপস্থিতিতে উৎসুক মানুষের জটলা বাড়তে থাকে। আর এই জটলা দেখে শাকিলের বিরক্তি বাড়তে থাকে।

ফাতেমা-তুজ জোহরা জানান, তিনি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাঙালিদের সহায়তায় পরিচালিত সাইলেন্ট হ্যান্ড সাপোর্ট নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে জড়িত। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে শাকিলের জন্য কিছু করা যায় কি না, তা তাঁরা ভাবছেন।

বেলা আড়াইটার দিকে শাকিলের মা হনুফা বেগম একটি বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিয়ে এলেন। এসে কিছুক্ষণের জন্য শাকিলের পায়ের শিকল খুলে দিলেন। এরপর শাকিল কয়েকবার মাকে জড়িয়ে ধরেন। মায়ের মুখে হাসি। তিনি জানান, তাঁকে দেখলে এই কাজটি করেন শাকিল। বিস্কুট খাওয়ানোর পর আবার যখন পায়ে শিকল বাঁধতে গেলেন, তখনই দেখা দিল বিপত্তি। শাকিল কিছুতেই শিকল বাঁধতে দেবেন না।

হনুফা বেগম বলেন, ‘এই ছেলেকে ১৯ বছর ধইরা টানতাছি। এখন আমার সারা শরীরে ব্যথা। ছেলের সঙ্গে আর পারি না। কিন্তু ছাইড়া রাখতে পারি না। কখন গাড়ির নিচে পইড়া অ্যাকসিডেন্ট করে। তাই মা হইয়াও নিজেই ছেলের পায়ে শিকল বান্ধি।’

হনুফা বেগম জানান, শাকিল যখন মাত্র বসা শুরু করেছেন, তখন তাঁর বাবা মারা যান। সাত বছর বয়সে শাকিলের জ্বর হয়, তারপর থেকেই মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে। তাঁর (হনুফা) বোন যে বাড়িতে কাজ করেন, সে বাড়িরই একটি জায়গায় থাকার সুযোগ পেয়েছেন। বোনের স্বামী আরেক বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। আর এ বোনের সংসারেই ঠাঁই পেয়েছেন তিনি ও শাকিল। তাঁরা যে ঘরের মেঝেতে ঘুমান, সেখানে পাশাপাশি দুজন মানুষের দাঁড়ানোও কষ্টকর।

শাকিলের জন্য মাসে ওষুধ লাগে প্রায় দুই হাজার টাকার। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে শাকিলের জন্য যেসব ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে, তা যত্ন করে গুছিয়ে রেখেছেন হনুফা বেগম।

হনুফা জানান, শাকিল যত বড় হচ্ছে, ততই তাঁর মানসিক সমস্যা বাড়ছে। ছেড়ে রাখলে এলাকার ছোট ছেলেমেয়েরা পাগল বলে মারে। তিনি জানান, শাকিল প্রতিবন্ধী ভাতা পান।

হনুফা বলেন, ‘ছেলের চিকিৎসা, মা-ছেলের খাওয়ার খরচ চালানোর জন্যই মানুষের বাড়িতে কাজ করি। রাইতে এহন ছেলেরে নিয়া বাড়ি যাইতে পারি। কিন্তু আমি মইরা গেলে...।’

বিস্কুট খাওয়ানোর পর শাকিলকে রেখে আবার কাজে চলে যাচ্ছেন মা। তখন শাকিলের চিৎকারের মাত্রা বাড়তে থাকে। তবে এ কান্না বা চিৎকারের অর্থ কেউ বুঝতে পারেন না। হনুফা হয়তো বোঝেন, কিন্তু তাঁর এ ছাড়া আর কিছু করার নেই।