বায়োগ্যাসে সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য

বায়োগ্যাসে চলছে রান্না। গতকাল দুপুরে সিরাজদিখানের ইছাপুরা এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বায়োগ্যাসে চলছে রান্না। গতকাল দুপুরে সিরাজদিখানের ইছাপুরা এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

শেফালি বেগম গৃহিণী। প্রায় ১০ বছর আগে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ না হতেই শ্বশুরবাড়িতে রান্নার কাজে হাত দিতে হয় তাঁকে। তখন ছিল মাটির চুলা। জ্বালানি বলতে ছিল শুকনা গোবর, পাটখড়ি। চুলায় আগুন ধরালেই ধোঁয়ার সৃষ্টি হতো। চোখ-মুখ জ্বালা করত। কিন্তু উপায় ছিল না। অবশ্য প্রযুক্তির কল্যাণে এখন শেফালির এই কষ্ট আর নেই। বায়োগ্যাসে তিনি স্বচ্ছন্দে রান্নাবান্না করছেন। জ্বলছে ঘরের বাতি, ঘুরছে পাখা।

শেফালির বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের বয়রাগাদি এলাকায়। শুধু শেফালি নন, এ উপজেলার প্রায় ৫০০ পরিবার বায়োগ্যাসের সুবিধা ভোগ করছে। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতা করছে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ইমপ্যাক্ট প্রকল্প।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, অত্যন্ত সাশ্রয়ী ও বহুমুখী সুবিধার কারণে সিরাজদিখান উপজেলায় দিন দিন খামারি ও কৃষকদের মধ্যে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বর্তমানে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ৩৬৫টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট রয়েছে। গোবর থেকে তৈরি হচ্ছে পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস। এতে জ্বালানি বাবদ অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। তা ছাড়া গ্যাস তৈরির পর পরিত্যক্ত জৈব পদার্থ জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার উপজেলার ইছাপুরা, বয়রাগাদি, গোবরদি, দানিয়াপাড়া, আবির পাড়া, চোরমর্দন, পালপাড়াসহ ১০টি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গরুর খামার থেকে ছোট নালার মাধ্যমে বায়োগ্যাসের কূপে গোবর প্রবেশ করানো হচ্ছে। সে কূপ থেকে উৎপন্ন গ্যাস দিয়ে চুলায় রান্না করছেন গৃহিণীরা। বয়রাগাদি এলাকায় কথা হয় শেফালি বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বায়োগ্যাস স্থাপনের কারণে রান্নাবান্না ও ঘরের বাতি জ্বালাতে পারছি। এতে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।’

ইছাপুরা এলাকার সাইদুর রহমান, আয়শা বেগম, মোহাম্মদ আলী, মমিনুল ইসলাম ও মোকছেদ আলীসহ কমপক্ষে ২০ জনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, চার বছর ধরে তাঁরা বায়োগ্যাস দিয়ে রান্না করছেন। বায়োগ্যাস তৈরির জন্য সিমেন্টের কূপ তৈরিতে তাঁদের প্রত্যেকের ৪০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। প্রতিটি কূপে দৈনিক ৬০-৮০ কেজি গোবর দিতে হয়।

বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সুবিধাভোগী সোহরাব মিয়া জানান, তিনি পোলট্রি খামার ও গরুর খামারের বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন। নিজে গ্যাস ব্যবহার করছেন এবং বাণিজ্যিকভাবে চারটি সংযোগও দিয়েছেন। এতে তাঁর বাড়তি আয় হচ্ছে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ইমপ্যাক্ট প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের মধ্যেপাড়া এলাকায় প্রথম বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। প্রথম বছরে উপজেলার ১০টি পরিবার প্ল্যান্ট পায়। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১০০টি, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১৫৮টি, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৮৭টি এবং চলতি বছরে ১১টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। সাতটি প্ল্যান্টের নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন। বাড়িতে তিনটি সংকর জাতের গরু থাকলেই ১০০ সিএফটি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা সম্ভব। এর মাধ্যমে দুটি চুলা জ্বলবে। ৩০০ সিএফটির প্ল্যান্টের মাধ্যমে ছয়টি চুলা জ্বালানো যাবে। এতে আট-নয়টি পরিবার রান্নার কাজে ব্যবহার করতে পারবে।

উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা ডলি রাণী নাগ বলেন, বায়োগ্যাস পরিবেশবান্ধব জ্বালানি। এতে তেমন খরচ নেই। পাশাপাশি কাঠ ও কয়লার অপচয় রোধ হয়। মুন্সিগঞ্জ জেলার মধ্যে একমাত্র সিরাজদিখান উপজেলায় ৩৬৫টি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। ৪৩৫ জন নারী-পুরুষকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের ২২ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর মোহাম্মদ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়োগ্যাস স্থাপন করে আমরা ৯৯ ভাগ সফল। আমাদের উপজেলার অল্প কয়েকটি এলাকার মানুষ লাইনে সরবরাহকৃত গ্যাস ব্যবহার করে। তাই সাধারণ মানুষের জন্য প্রধান বিকল্প হচ্ছে বায়োগ্যাস। বায়ো প্ল্যান্টের ভেতরে থাকা জৈব পদার্থগুলো জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য আমরা সরকারিভাবে কিনে নিচ্ছি এবং কৃষকদের স্বল্প মূল্যে দিচ্ছি। এতে করে পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে না।’