কাপড়ের সঙ্গে স্বপ্ন বুনছেন কারাবন্দীরা

পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত কারাবন্দীরা। গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে।  ছবি: হাসান রাজা
পোশাক তৈরিতে ব্যস্ত কারাবন্দীরা। গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে। ছবি: হাসান রাজা

লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি রঙের সুতায় রঙিন স্বপ্ন বুনে চলেছেন তাঁরা। একদিকে তাঁতের খটাখট আওয়াজ, অন্যদিকে চলছে এমব্রয়ডারি মেশিন। চারদেয়ালে বন্দী থেকেও তাঁদের চোখেমুখে প্রশান্তি। যেন নিজেকে শুধরে নেওয়ার, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা। মুখরক্ষা হচ্ছে পরিবারের কাছেও। লেখাপড়া শেখাতে পারছেন সন্তানদের।

যাঁদের কথা বলছি, এই মানুষগুলো নানা অপরাধে কারাবন্দী। তাঁদের জন্য সংশোধন ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার অংশ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে এ পোশাক কারখানা করা হয়েছে। যাঁদের দীর্ঘ মেয়াদে ৮ কিংবা ১০ বছর কারাগারে থাকতে হবে, তাঁদেরই মূলত এই কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা কারাগারের উদ্যোগে এই কারখানা গড়ে তোলা হয়। নাম দেওয়া হয়েছে ‘রিজিলিয়েন্স’। কারাগারের ভেতরে মূলত অলস সময় কাটে বন্দীদের। নানা ধরনের অপরাধের বন্দীর সঙ্গে সময় কাটানোর ফলে অন্য অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েন তাঁরা। অনেকে হতাশায় ভোগেন। মূলত তাঁদের পুনর্বাসন করতেই এই উদ্যোগ। উদ্যোক্তারা মনে করেন, তাঁরা অনেকটা সফল হতে পেরেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও কারাগার সূত্র জানায়, অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিয়ে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানাটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বেসরকারি উদ্যোগ ছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কারিগরি সহায়তা দিয়েছে এই কাজে। এই কারখানা ও জামদানি পণ্য উৎপাদন কেন্দ্রের আয়তন সাত হাজার বর্গফুট। কারাগারের বন্দীদের মধ্যে ৩৬০ জন পোশাক কারখানা, ৪০ জন তাঁতপল্লিসহ কুটিরশিল্পে কাজ করছেন। কারখানায় পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, নিটিংসহ নানা ধরনের কাজ হচ্ছে। কারাগারের ভেতরে এই কারখানায় বন্দীদের নিপুণ হাতে তৈরি হচ্ছে নকশিকাঁথা, চাদর, গেঞ্জি, পুঁতির কাজ, কাঁথা, পাটি, মগসহ বিভিন্ন পণ্য। এ ছাড়া বন্দীরা মাশরুম চাষ করছেন। দেশি অন্যতম বড় বুটিক প্রতিষ্ঠান আড়ংয়ের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) বাজারজাতসহ সংশ্লিষ্ট সব কাজে সহায়তা করছে। কারাবন্দী তাঁতিরা প্রতিটি জামদানি শাড়ি তৈরি করে দুই হাজার টাকা এবং পোশাকশ্রমিকেরা মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা পাচ্ছেন। এ টাকা কেউ জমাচ্ছেন, কেউবা পরিবারের কাছে পাঠাচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক রাব্বী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প নিয়ে তাঁদের অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। সব কারাগারের জন্য এমন কারখানা করার একটি পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, এই কারখানা করার পর তাঁরা বেশ সাড়া পেয়েছেন। শূন্য হাতে তাঁরা কাজটি শুরু করেছিলেন। কারও কাছ থেকে নগদ টাকা নেওয়া হয়নি। শেষের দিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা নেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা এই কারখানার আয়তন আরও বাড়াতে চাই, আমরা চাই আরও বন্দী কাজ করুক।’

কারাগার সূত্র জানায়, কারাবন্দীদের মধ্যে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মাদকসেবী। এ কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা ভালো হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তাঁরা নিজে থেকেই বলছেন, এ কাজের মাধ্যমে তাঁরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন। তাঁরা নিজেদের বদলাতে চান।

নারায়ণগঞ্জ কারাগারের জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে জানান, ‘সব মিলিয়ে এখন ৪০০ কারাবন্দী পোশাক কারখানা, তাঁত ও কুটিরশিল্প প্রকল্পে কাজ করছেন। তাঁদের আমরা বিক্রির লভ্যাংশ দিচ্ছি। আমাদের বন্দীদের তৈরি করা শাড়ি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উপহার দিয়েছি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশসহ (বিজিবি) অনেকেই আমাদের তৈরি পণ্য নিচ্ছে। বন্দীদের মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা সবাই জানিয়েছেন, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবেন। পরিশ্রম করে আয় করবেন।’

গত ২৭ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পোশাক কারখানাটির উদ্বোধন করেন। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত প্রায় এক বছরে বন্দীদের তৈরি পণ্য বিভিন্ন সংস্থা নিয়েছে এবং তারা পণ্যের মান সম্পর্কে ভালো বলেছে। এ ছাড়া কাজ করার ফলে বন্দীদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। দেশের সব কারাগারে পর্যায়ক্রমে এ ধরনের পোশাক কারখানা গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।