লাল ইটের সবুজ স্কুল

বৃক্ষশোভিত জুরাইনের আলমবাগ এলাকার হাজেরা উচ্চবিদ্যালয়।  ছবি: প্রথম আলো
বৃক্ষশোভিত জুরাইনের আলমবাগ এলাকার হাজেরা উচ্চবিদ্যালয়। ছবি: প্রথম আলো

লাল ইটের চারতলা ভবন। বেশ খানিকটা দূর থেকেই চোখে পড়ে। আর দৃষ্টি আটকে যায়।

দেয়ালজুড়ে গাছ আর গাছ। কোনোটি লতিয়ে উঠছে তার বেয়ে, কোনোটি মেলে দিয়েছে ডালপালা। কারও ডগায় দুলছে রঙিন ফুল। রোদে–জলে তাদের বেড়ে ওঠার দুরন্ত উচ্ছ্বাস। কৌতূহলী হয়ে ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই এক ফালি উঠোনে দেখা হলো কৃষ্ণচূড়া আর বকুলের সঙ্গে। গত মঙ্গলবার মধ্যবেলায়।

কদমতলী থানার নতুন জুরাইনের আলমবাগ এলাকায় এই চারতলা ভবন একটি বিদ্যালয়ের। নাম হাজেরা উচ্চবিদ্যালয়। প্রায় ২৭ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮১ সালে। প্রয়াত শিল্পপতি মোহাম্মদ আলম তাঁর মায়ের নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর নিজের নামে ওই এলাকার নাম হয়েছে আলমবাগ।

ভেতরে এসে দেখা গেল আরও ভালো করে। ইংরেজি ‘এল’ আকারের ভবন। প্রতিটি তলার বারান্দার সামনে, রেলিংয়ের পাশে, জানালার কার্নিশে, বড় বড় টব, ড্রাম—এসব শক্তপোক্ত করে বসানো হয়েছে। তাতে লাগানো হয়েছে নানা জাতের গাছ। পানি দেওয়ার ব্যবস্থাও চমৎকার। লম্বা পাইপ দিয়ে প্রতিটি টবের সঙ্গে পানির সংযোগ দেওয়া হয়েছে। মাথায় আছে কল। চাবি ঘুরিয়ে দিলেই পানির ধারা।

ছাদে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়, রীতিমতো বাগান। ইট গেঁথে সারি সারি চৌকোণ ক্ষেত্র করে তার ভেতর লাগানো হয়েছে হরেক রকম মৌসুমি ফলের গাছ। প্লাস্টিকের ড্রামেও গাছ লাগানো হয়েছে। ফুল গাছ আছে অল্প কিছু। ফল ধরেছে, ফুল ফুটেছে কয়েকটিতে। ‘আপাদমস্তক’ কথাটি ঘরবাড়ির সঙ্গে যায় না, তবে প্রকৃতপক্ষেই একেবার আঙিনা থেকে ছাদ পর্যন্ত—রুক্ষ ইটের পুরো বাড়িটিই সবুজে স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে।

স্কুল ভবনটি সবুজ করে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের জুন মাসে।

মূল উদ্যোগ ছিল স্কুলের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশীদ ও পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নুর আলমের। তাঁরা প্রথম আলোকে জানালেন, শুরুতে স্কুলের সামনের আঙিনায় ফুল গাছ আর ছাদে ফল গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। জায়গা অল্প। তাই আঙিনায় বড় গর্ত করে ৫টি বকুল ও ৫টি কৃষ্ণচূড়ার চারা লাগানো হয়। এই গাছগুলো বেশ বড় হবে, তাই অনেক বড় গর্ত করতে হয়েছে। বাইরে থেকে দুই ট্রাক সারযুক্ত মাটি এনে গর্ত ভরাট করে বড় আকারের চারা লাগানো হয়। এ ছাড়া ভবনের দেয়ালের সামনের মাঠে ১৬টি ড্রামে ফুল গাছের চারা লাগানো হয়। এরপর শুরু হয় ছাদে গাছ লাগানোর পালা।

ছাদে রয়েছে বাগানবিলাস, মধুমালতী, অপরাজিতাসহ সাত রকমের ফুল গাছ। ফলের মধ্যে আছে ২২টি থাই পেয়ারা, ২টি বারি পেয়ারা, ৫০টি আপেল কুল, ৪টি বাউকুল, করমচা, জামরুলসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফলের গাছ। কুলগাছগুলোতে ফুল এসেছে, ফলও ধরেছে কয়েকটিতে। ছাদ ও আঙিনার পর নেওয়া হয় দেয়ালগুলো সবুজে ঢেকে দেওয়ার উদ্যোগ। গত জুলাই থেকে ব্যাপক পরিসরে বিদ্যালয়জুড়ে ফুল ও ফল গাছ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। চারতলা ভবনের বাইরের কার্নিশগুলোর ফাঁকে ইট দিয়ে ঘিরে আর প্লাস্টিক ড্রাম বসিয়ে ২০৮টি জায়গা করা হয়েছে গাছ লাগানোর জন্য। এতে চার শতাধিক চারা লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে বাগানবিলাস ১৬৫টি, মধুমালতী লতা ৭০টি, নীল অপরাজিতা ৩০টি, বেলি ৪০টি, হাসনাহেনা ৩০টি, কসমস ১০টি, ক্যামেলিয়া ৫টি, গাঁদা ২০টি, গন্ধরাজ ৪০টি, চন্দ্রমল্লিকা ১০টি এবং গোলাপ চারা চারটি। স্কুল ভবনের এই সবুজায়ন দেখে শিক্ষার্থী আর এলাকাবাসীও মুগ্ধ। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তারের বাবা আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, পুরো প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন মনে হচ্ছে এখানকার পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

কারা এই সবুজায়নের পরিচর্যা করে? প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশীদ জানালেন, হাজেরা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজারখানেক। শিক্ষক–কর্মচারী ৩৪ জন। তাঁদের নিয়েই তিনি এসব গাছের পরিচর্যা করেন। এতে শিক্ষার্থীরা হাতে–কলমে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। প্রকৃতি, পরিবেশ বিষয়েও তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐশী আক্তার বলল, ফুল ও ফল গাছের চারা লাগানোর পর স্কুলের চেহারাই বদলে গেছে। এখন পরিবেশ খুব ভালো লাগে।

সভাপতি নুর আলম জানালেন, এই সবুজায়ন কর্মসূচিতে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় সাত লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর অধিকাংশই তিনি ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছেন।

স্কুলটি ঘুরে আরও দেখা গেল, কেবল সবুজায়নই নয়, প্রযুক্তির ব্যবহারেও তারা এগিয়ে এসেছে। শ্রেণিকক্ষগুলো ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসি) আওতায় আনা হয়েছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী এবং স্কুলের শিক্ষক ও কর্মচারীদের সবার জন্যই ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে দেওয়া হয়েছে ইন্টারকম। শিক্ষার মান উন্নয়নেও জোর দেওয়া হয়েছে। গত এসএসসিতে ১৮৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৫২ জন। এলাকাটি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই নিম্নবিত্ত পরিবারের। প্রধান শিক্ষক জানালেন, তাদের লক্ষ্য আগামী তিন বছরের মধ্যে শিক্ষার মানেও ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্কুলগুলোর মধ্যে সেরা দশে উঠে আসা। তাই অব্যাহত থাকবে সবুজে স্নিগ্ধ, শিক্ষায় উন্নত হওয়ার লক্ষ্যে তাদের এই অভিযাত্রা।