যখন যেমন, তখন তেমন নিয়ম?

মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম, ইয়াফেস ওসমান ও মোস্তাফা জব্বার।
মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম, ইয়াফেস ওসমান ও মোস্তাফা জব্বার।

নির্বাচনকালীন সরকারে টেকনোক্র্যাট অর্থাৎ সাংসদ নন এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রী হিসেবে রাখা যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় রায়ের কারণে এটা সম্ভব নয় বলে দাবি করছে সরকার। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় এই প্রসঙ্গ তোলেনি তারা। তখন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের পদত্যাগের যুক্তি হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারে জায়গা করে দেওয়ার কথা বলা হয়।

আবার সংসদীয় ব্যবস্থার রেওয়াজ হলো, মন্ত্রী বা সাংবিধানিক পদধারীরা পদত্যাগ করামাত্র তা কার্যকর হবে। অবশ্য এ নিয়ে দ্বিমতও আছে। কেউ কেউ মনে করেন, যে কারও পদত্যাগপত্রই দায়িত্বপ্রাপ্ত কারও দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। আবার ১৯৯৪ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে আওয়ামী লীগের ১৪৭ সাংসদ একযোগে পদত্যাগ করেছিলেন। তখন স্পিকার তাতে অনুমোদন দেননি। পরে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে বিশেষ রেফারেন্স পাঠান। সর্বোচ্চ আদালত তখন বলেছিলেন, সাংসদদের পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে পৌঁছামাত্র তা আপনাআপনি কার্যকর হয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, তথ্য ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম ৬ নভেম্বর পদত্যাগ করেছেন। এঁরা সবাই টেকনোক্র্যাট।

২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীরাও পদত্যাগ করেছিলেন। পরে অবশ্য তাঁদেরকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তখনকার আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী করার প্রস্তাব করেছিলেন। সে অনুযায়ী বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ারও প্রস্তাব ছিল। তিনি বলেন, ‘সে সময় আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, যেহেতু বিএনপিকে মন্ত্রিসভায় জায়গা করে দিতে হবে, তাই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের সরে যাওয়াই সমীচীন হবে। প্রধানমন্ত্রী এটা গ্রহণ করেছিলেন এবং সে অনুযায়ী আমিসহ অন্য অনির্বাচিত মন্ত্রীরা পদত্যাগ করি।’

ফলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে নির্বাচনকালীন সরকারে যে যুক্তিতে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের রাখা হয়নি, এবার সে যুক্তি আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। এবার বলা হচ্ছে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের কথা। ২০১৩ সালে যখন বিএনপিকে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল সরকার, তখনো সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বলবৎ ছিল। কিন্তু তখন একে বাধা হিসেবে দেখা হয়নি।

সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী পর্যালোচনা করে মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে চার রকম বিধান পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের পর এ–সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ তিনবার (১৯৭৫,১৯৭৮ ও ১৯৯১) পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে আবার’ ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে বলা হয়েছে।

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলায় তখনকার প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে দেওয়া রায়ের ১৬ দফা নির্দেশনার মধ্যে ১৫ নম্বর দফায় বলা হয়, ‘বিদ্যমান সংবিধানের ৫৬ (২) অনুচ্ছেদের পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রের স্বার্থে আনয়ন করা প্রয়োজন।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে অনধিক ছয় মাসের জন্য ‘প্রয়োজনীয় সংখ্যক’ টেকনোক্র্যাট অর্থাৎ অনির্বাচিতদের মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারবেন। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদে অনির্বাচিতদের মন্ত্রীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করা নেই।

এই মামলার রায় থেকে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়টুকু গ্রহণ করেছে। কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদটি গ্রহণ করেনি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গত রাতে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়নি।’

ওই মামলায় বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সরকারের তৈরি বাহাত্তরের সংবিধান যদি ছয় মাস অনির্বাচিত কাউকে মন্ত্রী রাখা অনুমোদন করে, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা কেন অনধিক মাত্র ৯০ দিনের জন্য বহাল থাকতে পারবেন না?

১৮০ দিন বা ছয় মাসের মেয়াদে ‘প্রয়োজনীয় সংখ্যক’ টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী রাখার বিধান ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল। কিন্তু পরে জিয়াউর রহমান এসে টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের মেয়াদকাল ‘অনির্দিষ্ট’ করে দেন। একই সঙ্গে তিনি মন্ত্রিসভার ২০ শতাংশ সদস্য অনির্বাচিত হতে পারবেন বলে বিধান করেন। ১৯৯১ সালে তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনেন।

আবার ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে প্রধানমন্ত্রীসহ যেকোনোসংখ্যক মন্ত্রী পদে অনির্বাচিতদের নিয়োগের বিধান করা হয়েছিল। সংবিধানের ৫৮ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতি তাঁর বিবেচনায় সংসদ সদস্যগণের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি যেরূপ আবশ্যক মনে করবেন সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করবেন।’ তবে এই বিধান এখন কার্যকর নেই।