পাবনায় কি ফের আওয়ামী লীগ?

নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নানা আশঙ্কা, জল্পনা-কল্পনা থাকলেও পাবনার পাঁচটি আসনে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীরা। সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠক, শুভেচ্ছাবিনিময়, শোভাযাত্রা ও বিলবোর্ড, পোস্টার-ব্যানার লাগিয়ে জানান দিচ্ছেন নিজেদের প্রার্থিতার কথা। দলীয় সমর্থন পেতে কেউ কেউ ছুটছেন ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে।

অন্যদিকে দলের কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত না পেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ঘোষিত মামলার রায় প্রত্যাহারের দাবি তুলে ভোটারদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীরা।

এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের প্রথম নির্বাচনে পাবনার ৫টি আসনের মধ্যে পাবনা-১ ও ৫ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন জামায়াতের প্রার্থী। পাবনা-২, ৩ ও ৪ আসন ছিল বিএনপির দখলে। ১৯৯৬ সালে পাবনা-৫ বিএনপি ছিনিয়ে নিলেও, বাকি চারটি আসন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে ৪টি আসন ছিনিয়ে নেয় বিএনপি-জামায়াত। শুধু পাবনা–৪ আসনটি আ.লীগের দখলে ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পাঁচটি আসনই আওয়ামী লীগের দখলে আসে। ২০১৪ সালেও অবস্থান ধরে রাখে দলটি। আসন্ন নির্বাচনে সব কটি আসনে জয়ী হতে চায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে হারানো আসন ফিরে পেতে চায় বিএনপি। ফলে জনগণের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলনে যোগ্য প্রার্থী চান দুই দলেরই তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।

সাংসদ শামসুল হক টুকু (পাবনা–১; আ. লীগ), খায়রুন নাহার খানম (পাবনা-১; বিএনপি), অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা-১; আ. লীগ)
সাংসদ শামসুল হক টুকু (পাবনা–১; আ. লীগ), খায়রুন নাহার খানম (পাবনা-১; বিএনপি), অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা-১; আ. লীগ)



পাবনা-১ (সাঁথিয়া ও বেড়ার একাংশ)
জেলার সাঁথিয়া উপজেলা ও বেড়া উপজেলার আংশিক নিয়ে পাবনা-১ আসন। রয়েছে পালাবদলের ইতিহাস। বিগত পাঁচটি নির্বাচনে এই আসনে দুবার জামায়াত ও তিনবার আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, এই আসনে জামায়াতের ভোট ব্যাংক রয়েছে। ১৯৯১ ও ২০০১-এর নির্বাচনে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এখানে জয় পেয়েছিলেন। তবে ভোট ব্যাংকের বিষয়টি মানতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। যুদ্ধাপরাধে নিজামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর জামায়াত বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এবার এই আসন থেকে মনোনয়ন পেতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এখান থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন। এবারও মনোনয়ন পেতে আশাবাদী তিনি। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। তিনি ১৯৯৬ সালে এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর পক্ষে স্থানীয়দের সমর্থনও রয়েছে জোরালোভাবে। এ ছাড়া সাঁথিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা সরদার সোহেল মাহমুদ মনোনয়নের প্রত্যাশায় প্রচারণা চালাচ্ছেন।

আসনটিতে বিএনপির জোরালো কোনো প্রার্থী না থাকলেও, এলাকাবাসী ও স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী অবসরপ্রাপ্ত মেজর মঞ্জুর কাদেরকে প্রার্থী হিসেবে প্রত্যাশা করছেন। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি খায়রুন নাহার খানম ও জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাজিব মোমেন মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। ওদিকে জাতীয় পার্টি থেকে জেলা জাতীয় পার্টির নেতা নাসির উদ্দিন প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক (পাবনা-২; আ. লীগ), আহম্মেদ ফিরোজ কবির (পাবনা-২; আ. লীগ), সেলিম রেজা হাবিব (পাবনা-২; বিএনপি), এ কে এম কামরুজ্জামান খান (পাবনা-২; আ. লীগ)
সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক (পাবনা-২; আ. লীগ), আহম্মেদ ফিরোজ কবির (পাবনা-২; আ. লীগ), সেলিম রেজা হাবিব (পাবনা-২; বিএনপি), এ কে এম কামরুজ্জামান খান (পাবনা-২; আ. লীগ)

পাবনা-২ (বেড়া-সুজানগর)
বেড়া উপজেলার আংশিক ও সুজানগর উপজেলা নিয়ে পাবনা-২ আসন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী খন্দকার আজিজুল হক। ফলে এবারও তিনি মনোনয়ন পেতে আশাবাদী। তবে তাঁকে টপকে মনোনয়ন ছিনিয়ে নিতে মাঠে নেমেছেন দলটির প্রায় এক ডজন নেতা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, সুজানগর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহম্মেদ ফিরোজ কবির, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক এ কে এম কামরুজ্জামান খান, কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মির্জা আব্দুল জলিল, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও রাকসুর সাবেক জিএস জাহাঙ্গীর কবির, সাবেক সচিব মজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য আশিকুর রহমান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ইমরান সিরাজসহ বেশ কয়েকজন।

২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসনে নির্বাচিত হন বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য সেলিম রেজা হাবিব। এবারও তিনি মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। এ ছাড়া মনোনয়নের প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন দলের অপর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য হাসান জাফির, সুজানগর থানা বিএপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক আসলাম হোসেনসহ কয়েকজন নেতা।

আবদুল হামিদ (পাবনা-৩; আ.লীগ), মাসুদ খোন্দকার (পাবনা-৩; বিএনপি), সাংসদ মকবুল হোসেন (পাবনা-৩; আ.লীগ)
আবদুল হামিদ (পাবনা-৩; আ.লীগ), মাসুদ খোন্দকার (পাবনা-৩; বিএনপি), সাংসদ মকবুল হোসেন (পাবনা-৩; আ.লীগ)

পাবনা-৩ ( চাটমোহর-ভাঙ্গুড়া-ফরিদপুর)
জেলার সবচেয়ে বেশি উপজেলা নিয়ে পাবনা-৩ আসন। ভোটারসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। ফলে মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও বেশি। আসনটিতে এ পর্যন্ত দুবার বিএনপি ও তিনবার আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। ২০০৮ সালে জয়ের মুখ দেখেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মকবুল হোসেন। ২০১৪ সালেও তিনিই নির্বাচিত হন। তবে এবার অভিযোগ রয়েছে, তিনি নাকি তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন না। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা সাংসদবিরোধী জোট তৈরি করেছেন। এ জোটে রয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল আলিম, আতিকুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আ স ম আবদুর রহিম, সহসভাপতি আবদুল হামিদ, চাটমোহর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, পাবনা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শাহ আলম, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সরকার, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফুল কবীরসহ আরও কয়েকজন।

বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সাবেক সাংসদ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সহসভাপতি আইনজীবী মাসুদ খোন্দকার, বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান সাইফুল আযম, ফরিদপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতা।

ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ (পাবনা-৪; আ.লীগ), এ এস এম নজরুল ইসলাম (পাবনা-৪; আ.লীগ), সিরাজুল ইসলাম সরদার (পাবনা-৪; বিএনপি)
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ (পাবনা-৪; আ.লীগ), এ এস এম নজরুল ইসলাম (পাবনা-৪; আ.লীগ), সিরাজুল ইসলাম সরদার (পাবনা-৪; বিএনপি)

পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া)
ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া উপজেলা নিয়ে পাবনা-৪ আসন। ১৯৯১ সালে একবারই বিএনপির প্রার্থী এ আসনে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে আসনটি দখল করে রেখেছে আওয়ামী লীগ। পরপর চারবার নির্বাচিত হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ। জনশ্রুতি আছে, বিএনপির দলীয় কোন্দলেই আওয়ামী লীগ এই সুযোগ পেয়েছে। তবে শামসুর রহমান শরীফের সমর্থকেরা মনে করেন, জনপ্রিয়তা বেশি থাকায় তিনি বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন।

তবে গত পাঁচ বছর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের কিছু কার্যক্রমে শামসুর রহমান শরীফের জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমে গেছে। মনোনয়নের প্রত্যাশায় আছেন আরও বেশ কয়েকজন নেতা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর এ এস এম নজরুল ইসলাম, সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ী আবদুল আলীম, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রবিউল আলম, পৌর আওয়ামী লীগের নেতা মিজানুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন।

অন্যদিকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম সরদার, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান, ঈশ্বরদী উপজেলা বিএনপির সভাপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মালিথা, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়র মকলেছুর রহমান, শিল্পপতি আকরাম আলী খানসহ কয়েকজন।

সাংসদ গোলাম ফারুক (পাবনা-৫; আ. লীগ), শিমুল বিশ্বাস (পাবনা-৫; বিএনপি)
সাংসদ গোলাম ফারুক (পাবনা-৫; আ. লীগ), শিমুল বিশ্বাস (পাবনা-৫; বিএনপি)

পাবনা-৫ (সদর আসন)
পাবনার রাজনীতিতে সদর আসনটি গুরুত্বপূর্ণ। পালাবদলও হয়েছে বেশ কয়েকবার। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত—তিন দলই এই আসনে কখনো না কখনো জয়ী হয়েছে। তাই সব দলই মনে করে, এই আসনটিতে তাদের ভোট ব্যাংক আছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে জামায়াতের প্রার্থী আবদুস সুবহানকে হারিয়ে চমক দেখান আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা গোলাম ফারুক। ২০১৪ সালে তিনি আবারও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। দলের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী তিনিই। তাঁর প্রচারণাই চলছে জোরেশোরে। তবে খুব বেশি প্রচারণা না থাকলেও, মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ইদ্রিস আলী বিশ্বাস, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি সাইদুল হকসহ বেশ কয়েকজন।

অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট এখনো প্রার্থী বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি। অবশ্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা একক প্রার্থী হিসেবে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসকে প্রার্থী হিসেবে চাইছেন। সে অনুযায়ী প্রচারণাও চলছে। তবে জামায়াত ভোটে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও, আসনটিতে নির্বাচন করতে চান জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি ইকবাল হুসাইন। নিজের প্রার্থিতার জানান দিতে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনিও।