সংলাপের পর ১০০ মামলা

>

• ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের পর ১০ দিনে ১০০ মামলা
• ১০০ মামলার মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদী পুলিশ
• বিএনপির দাবি, মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও গায়েবি

কেরানীগঞ্জের কদমতলী গোলচত্বরের কাছে ৬ নভেম্বর দুপুরে কিছু লোককে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাতে ও গাড়ি ভাঙচুর করতে ‘দেখেছে’ পুলিশ। কিন্তু কদমতলীর স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিস্ফোরণ হলে অন্তত শব্দ শোনা যেত। ভাঙচুর হলে এলাকায় শোরগোল হতো। এ ছাড়া সেদিন সকাল থেকেই কদমতলী এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ভাঙচুরের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঘটনাস্থল থেকে ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা মামলায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, সেদিন পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

এ ধরনের মামলার কথা ১ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রথম দফার সংলাপে তুলেছিলেন বিএনপির নেতারা। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হবে না।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ১ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বাইরে ২০ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১০০ টি। এর মধ্যে ৯৭টি মামলারই বাদী পুলিশ। বিএনপির নেতাদের দাবি, এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও গায়েবি।

আর ৬ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের দিন ঢাকার ছয়টি থানায় ছয়টি মামলা হয়। এসব মামলায় গাড়ি ভাঙচুর, রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, পুলিশের ওপর হামলা, ককটেল বিস্ফোরণসহ নাশকতার ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে। ছয়টি মামলায় ঘটনাস্থল থেকে ১৩৮ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা বলেছে পুলিশ। কিন্তু যে এলাকায় এবং যে সময়ে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। উল্টো এসব ঘটনার বিবরণ শুনে স্থানীয় লোকজন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে মামলা দেওয়া উচিত নয় বলে জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করা ঠিক নয়।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চাঁদপুর, কুমিল্লা, দিনাজপুর, ঝালকাঠি, কুষ্টিয়া, সিলেট, বরিশাল, বাগেরহাট, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নড়াইল, নওগাঁ, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১০০টি মামলা হয়েছে। এসব মলায় ২ হাজার ৩৮০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আড়াই হাজারের বেশি।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এসব মামলার সবই গায়েবি। মামলায় বর্ণিত ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। নেতা-কর্মীদের ধরে জেলে ঢোকাতেই এসব মামলা।

ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন করে মামলা হবে না বলে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তার বাস্তবায়ন নেই। গায়েবি মামলা অব্যাহত রয়েছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী শক্তিকে মাঠে নামতে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই মামলা ও ধরপাকড় চলছে।

গায়েবি ঘটনায় করা মামলার বিষয়ে সম্প্রতি উচ্চ আদালতে রিটও হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা গায়েবি মামলার একটি তালিকাও প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের পর ৬ নভেম্বর ঢাকায় হওয়া ছয়টি মামলার বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় প্রথম আলো।

কেউ জানে না
বিস্ফোরক আইনে করা কেরানীগঞ্জ থানার মামলায় বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগ দিতে মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর দক্ষিণ পাশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হন। পরে তাঁরা কদমতলী গোলচত্বরের লায়ন টাওয়ারের (সেতুর পাশেই) সামনে গাড়ি ভাঙচুর করেন। ঘটনাস্থল থেকেই ১৩ জনকে আটক করা হয়।

পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে কেরানীগঞ্জে যেতে হয় বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু পার হয়ে। এই সেতু পার হয়ে ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও দোহারে যাওয়া যায়।

বাবুবাজার সেতুসংলগ্ন লায়ন টাওয়ারের পাশেই এসএস মোটরসাইকেল সার্ভিস সেন্টার। ৮ নভেম্বর সেখানে গিয়ে কথা হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটির মালিক স্বপন সরকারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ককটেল বিস্ফোরণ বা গাড়ি ভাঙচুরের কোনো ঘটনাই তিনি দেখেননি।

লায়ন টাওয়ারের নিচতলার জেজে ফ্যাশনের মালিক মো. রকি বলেন, সেদিন সারা দিনই তিনি দোকানে ছিলেন। ভাঙচুর, হামলার কোনো ঘটনা তাঁর চোখে পড়েনি।

মামলার বাদী ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী এনায়েত হোসেন বলেন, লোকজন যা বলছে, তা মোটেও ঠিক নয়।

তবে পুলিশের করা মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী ও মাইক্রোবাসচালক সুলতান হোসেন বলেন, সেদিন তাঁর গাড়িতে করেই ওই ১৩ জন দোহার থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যাচ্ছিলেন। সেতুর কাছে তাঁকেসহ সবাইকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে তাঁকে ছেড়ে দিলেও অন্যদের নামে মামলা দেওয়া হয়।

লেগুনা ভাঙচুর নিয়ে মালিকের বিস্ময়
তেজগাঁও থানায় পুলিশের করা আরেকটি মামলায় বলা হয়েছে, ৬ নভেম্বর গ্রিন রোডের আরএইচ হোম সেন্টার বিল্ডিংয়ের সামনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা নাশকতা করার জন্য ইটপাটকেল, লাঠিসহ অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে সেখান থাকা লেগুনা গাড়িসহ (ঢাকা মেট্রো-ছ ১৪০৭৩৭) বিভিন্ন লেগুনা ভাঙচুর করেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি লেগুনা গাড়ি, ছয়টি ইটের টুকরা এবং বিভিন্ন লেগুনা গাড়ির কাচের টুকরা জব্দ করা হয়।

আরএইচ হোম সেন্টারের ঠিক সামনেই চা বিক্রি করেন সেন্টু নামের এক ব্যক্তি। ৮ নভেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন সারা দিনই তাঁর দোকান খোলা ছিল। লেগুনা ভাঙচুর বা পুলিশের সঙ্গে ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ির কোনো ঘটনা তিনি দেখেননি।

মামলার বাদী তেজগাঁও থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটেছিল। তাই হয়তো কেউ খেয়াল করেনি।

গ্রিন রোডের মাথাতেই লেগুনাস্ট্যান্ড। এই স্ট্যান্ড পরিচালনা করা শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির হোসেন বলেন, এই এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে লেগুনা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।

আর ওই লেগুনার (পুলিশের জব্দ করা) মালিক সাদ্দাম হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন চালক লেগুনাটি আরএইচ হোম সেন্টারের সামনে রেখে চা খেতে গিয়েছিলেন। এসে দেখেন, পুলিশ লেগুনাটি থানায় নিয়ে গেছে। পরে রাতে তাঁরা থানা থেকে লেগুনা ছাড়িয়ে আনেন।

এই মামলায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

দুই মাসেও বিএনপির সমাবেশ দেখেনি কেউ
গেন্ডারিয়া থানায় করা মামলায় পুলিশ বলছে, ৬ নভেম্বর বিকেলে সাদেক হোসেন খোকা মাঠের সামনে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে জনগণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেন। ঘটনাস্থল থেকে সাতজনকে পুলিশ আটক করে।

তবে মাঠের সামনে থাকা দোকান রুবেল স্টোরের মালিক বাদশা মিয়া জানান, সেদিন এখানে বিএনপির কোনো মিছিল হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গেন্ডারিয়া থানার এসআই বাবুল হোসেনের দাবি, নাশকতা করার জন্য সেদিন বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়েছিলেন।

নর্থ সাউথ রোডে প্রতিবন্ধক
পল্টন থানায় সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মামলায় পুলিশ বলেছে, ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিজয়নগরের রেইনবো গলির মুখে নর্থ সাউথ সড়কের ওপর বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। দফায় দফায় পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর সময় ৩৮ জনকে আটক করা হয়।
মামলার বাদী পল্টন থানার এসআই তবিবুর রহমান বলেন, যা ঘটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই মামলাটি করা হয়েছে।

রেইনবো গলির মুখে চায়ের দোকান রয়েছে আবুল খায়েরের। তিনি বলেন, এমন ঘটনা ঘটলে তাঁর দোকান বন্ধ থাকত। সেদিন রাত আটটা পর্যন্ত তিনি দোকানে ছিলেন।

ফাঁকা ছিল বিজি প্রেস উচ্চবিদ্যালয় এলাকা
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ বলছে, ৬ নভেম্বর দুপুরে বিজি প্রেস স্কুলের সামনে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ২৭ জনকে আটক করে।

স্কুল ও এর পাশের একটি প্রতিষ্ঠানের দুজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন, বাইরের কোনো লোক জড়ো হওয়া বা তাঁদের আটক করার মতো কোনো ঘটনা তিনি সেদিন দেখেননি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই বাবলুর রহমান বলেন, মামলাটি তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে বাকিটা বলা যাবে।

মিছিল দেখেননি, আটক করতে দেখেছেন
ওয়ারী থানায় করা মামলায় পুলিশ বলেছে, ৬ নভেম্বর বিকেলে ওয়ারীর কাপ্তানবাজারের কাছে এরশাদ সুপার মার্কেট-১-এর পশ্চিম পাশের রাস্তায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা জড়ো হয়ে যান চলাচলে বাধা দেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে আটক করে।

যদিও এরশাদ সুপার মার্কেটের সামনে থাকা দোকানের কর্মীরা বলেছেন, সেদিন বিএনপির কোনো মিছিল দেখেননি তাঁরা। তবে ঘটনাস্থল থেকে অনেককে আটক করে নিয়ে যেতে দেখেছেন। দোকানি মো. আসাদ ও এরশাদ সুপার মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষী কবির হোসেন বলেন, রাস্তায় গাড়ি চলাচলে বাধা দেওয়ার কোনো ঘটনাই সেদিন ঘটেনি।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবের সঙ্গে ঘটনার মিল নেই—এমন আজগুবি মামলা দিচ্ছে পুলিশ। যারা মিথ্যা অভিযোগে মামলা করছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। যা ঘটছে তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।