জোটে-আসনে সমঝোতা আ.লীগের

>

• ১৪ দলের বেশির ভাগের প্রতীক হবে নৌকা
• জাপাসহ অন্য মিত্ররা ভোট করবে নিজ প্রতীকে
• অন্যদের নিজ প্রতীকে ভোটে ঝুঁকি দেখছে আ. লীগ
• বেশি সম্ভব দলকে নৌকায় ভোটের তাগিদ দেওয়া হবে
• আ.লীগ প্রার্থীদের দলীয় সাক্ষাৎকার বুধবার

জোটগত ও আসন সমঝোতা—এই দুই প্রক্রিয়ায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল জোটগতভাবে ভোট করবে; বেশির ভাগের প্রতীক হবে নৌকা। আর জাতীয় পার্টিসহ তাদের অন্য মিত্রদের সঙ্গে হবে আসন সমঝোতা; তারা ভোট করবে যার যার প্রতীকে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের দলীয় সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে আগামীকাল বুধবার।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাদের মিত্র হিসেবে পেয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ এবারও তাদের সঙ্গে থাকছে। নতুন যোগ হচ্ছে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট এবং ধর্মভিত্তিক কিছু দল। ছোট দলের বড় নেতাকেও আসন ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা আছে আওয়ামী লীগের।

১৪ দল জোটগতভাবে নির্বাচন করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এ ক্ষেত্রে দলের সংখ্যা হবে ১৫। জাসদ দুই অংশে বিভক্ত হওয়ার কারণে দল একটা বেড়েছে। এরা নৌকায় অথবা নিজ দলের যেকোনো একটি প্রতীকে ভোট করবে বলে ইসিকে জানানো হয়েছে।

এর বাইরে এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি, যুক্তফ্রন্ট, ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্য কিছু দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে ওই দলগুলো নিজ নিজ প্রতীকে ভোট করবে। শেষ পর্যন্ত এই সমীকরণ ঠিক থাকলে এর নাম হয়ে যেতে পারে ‘মহাজোট’।

তবে গতকাল নির্বাচন কমিশন ভোট ৭ দিন পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেছে। ফলে জোটের শরিকদের তথ্য ইসিকে জানানোর যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাতে সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ আওয়ামী লীগ নেবে। দলটির সূত্র বলছে, জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্যদের নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার বিষয়ে ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য যত বেশি সম্ভব দলকে নৌকায় ভোট করার জন্য তাগিদ দেওয়া হবে। ছোট দলের কোনো বড় নেতার জেতার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দিয়ে মাঠে নামানো হবে।

আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশেই আওয়ামী লীগের ভেতরে কোন্দল আছে। এই অবস্থায় অন্য প্রতীকে ভোট করলে কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন হবে। নৌকা প্রতীক থাকলে ঐক্যবদ্ধ রাখা কিছুটা সহজ হবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, প্রথমে আওয়ামী লীগ নিজ দলের প্রার্থীতালিকা তৈরি করবে। এরপর জোটের শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় বসবে। আওয়ামী লীগ নিজেদের জন্য ২১০ থেকে ২২০টা আসন রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। আর শরিক ও মিত্রদের জন্য ৮০-৯০টি আসন ছেড়ে দিতে পারে। ওই সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ছয়টি পৃথক জরিপ করিয়েছেন। এসব জরিপে আওয়ামী লীগের, ১৪-দলীয় জোট, মিত্র ও বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের কার কী অবস্থান, তা উঠে এসেছে। শরিক ও মিত্রদের ইতিমধ্যে নিজ নিজ দলের ‘উইনেবল’ (জয়ী হতে পারেন এমন) প্রার্থী কারা, সেই তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। এই তালিকার সঙ্গে জরিপ মিলিয়ে তারপরই আসন ছাড় দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত রোববার সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন করতে পারে। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আমাদের জোট হতেও পারে। আলোচনা চলছে। তবে আমরা নিজেদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেব। আসন ভাগাভাগি হলে আমাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে ফেলা হবে।’

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের বাইরে এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা), আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি), ইসলামিক ফ্রন্ট ও মিছবাহুর রহমানের বাংলাদেশ ইসলামিক ঐক্যজোট ও জাকের পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অংশ ছিল।

আওয়ামী লীগ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের শরিক ও মিত্রদের সঙ্গে আসন নিয়ে আলোচনা শুরু করেনি। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ বা যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকৃত চাহিদা কী, তা বোঝার চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব বিষয়ে জ্ঞাত একটি সূত্র বলছে, ১৪ দলের শরিকদের দখলে বর্তমানে ১৫টি আসন আছে। এর বেশি আসনে এবার তাদের দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং যে শরিকদের সাংসদ নেই, অন্যদের কমিয়ে তাদের কাউকে কাউকে সুযোগ দেওয়া হতে পারে। জাপা ৮০ আসন নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বর্তমানে জাতীয় পার্টির সাংসদ আছেন ২৯ জন। সে ক্ষেত্রে ৩৫-৪০ আসনের বেশি তাদের দেওয়ার সুযোগ নেই।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিজেদের প্রতীকে ভোট করবেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটগত বা আসন সমঝোতার মাধ্যমে অংশ নেবেন। তবে আসন নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যে বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে থাকবে।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, ইসলামী ঐক্যজোট একাধিক আসন চাইছে। যুক্তফ্রন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে চাহিদা না জানালেও তাদের দলে বিএনপি থেকে আসা বড় কিছু নাম আছে। ফলে তাদের একাধিক আসন দিতে হতে পারে। ইসলামী ঐক্যজোট ও নামসর্বস্ব দলগুলোর কাউকে কাউকেও প্রার্থী করা হতে পারে।

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা হয়নি। নিজেদের প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্ত আছে। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।

যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র মাহী বি চৌধুরী গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।

নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের প্রথম বৈঠক হয় গত রোববার। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা প্রথমে দলের, পরে জোট ও মিত্রদের প্রার্থীতালিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন। ছোট কিছু দল ও জোটকে কিছু আসনে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতেও দলের নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। 

আ.লীগ প্রার্থীদের দলীয় সাক্ষাৎকার বুধবার
আওয়ামী লীগের আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার রাত ১০টায়। বুধবার দলটির ধানমন্ডি কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া নেতাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। চার হাজারের বেশি আগ্রহী প্রার্থী ফরম সংগ্রহ করেছেন। সবার সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হবে না। তাই বিভাগওয়ারি প্রার্থীদের ডেকে কুশল বিনিময় করতে পারেন দলীয় প্রধান। একপর্যায়ে আগ্রহীরা প্রধানমন্ত্রীকে একজন প্রার্থী ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দেবেন। এরপর একদিন গণভবনে সবাইকে ডেকে একটা সভাও হতে পারে।

ঘোষিত তফসিল অনুসারে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৮ নভেম্বর। এর আগে সব আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত না-ও হতে পারে। জোট-মিত্রদের আসন সমঝোতার প্রক্রিয়া জটিল বলে কোনো কোনো আসনে একাধিক প্রার্থীকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। তবে সবারই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চিঠিতে সই নিয়ে রাখা হবে। কাউকে বাদ দিতে চাইলে শেষ মুহূর্তে যাতে দলকে ঝামেলায় পড়তে না হয়, সে জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হবে।