সৌরবিদ্যুতে অন্ধকারমুক্তি

১১৬ একর জায়গায় বসানো ৮৭ হাজার সৌর প্যানেল নিয়ে এটি এই মুহূর্তে দেশের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। গত শুক্রবার কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
১১৬ একর জায়গায় বসানো ৮৭ হাজার সৌর প্যানেল নিয়ে এটি এই মুহূর্তে দেশের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। গত শুক্রবার কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

দেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ। উপজেলা ঘেঁষে বহমান নাফ নদী। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করা নদীটির তীর ধরে চলে গেছে টেকনাফ-কক্সবাজার আঞ্চলিক সড়ক। সড়কটির হ্নীলার আলীখালী এলাকায় রাস্তার পাশে একটি ঝুপড়ি চায়ের দোকান। সেখানে চলছিল টেলিভিশন। অনেক লোকজন চায়ে চুমুক দিতে দিতে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখছিলেন। তাঁদের একজন বললেন, ‘শুরু থেকে দেখছি। এখন সিনেমা শেষপর্যায়ে।’

তাঁর সঙ্গে সায় দিলেন আরও কয়েকজন। দোকানি আবু জাফর কথা টেনে নিয়ে হাতের ইশরায় রাস্তার ওপাশে দেখিয়ে বললেন, এত দিন বিদ্যুতের আসা–যাওয়া ছিল। সৌরবিদ্যুৎ হওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন লোডশেডিং নেই।

রাস্তার ওপাশে তাকিয়ে দেখা যায়, সারি সারি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তত্ত্বাবধানে ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। এত দিন সেখানে দিনরাত মিলিয়ে ছয়-সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ মিলত। এখন দিনরাত যেন আলোর বন্যা!

পিডিবির কক্সবাজার বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল হক বললেন, সোলার পার্কটি চালু হওয়ার পর টেকনাফের শতভাগ গ্রাহক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সুবিধা পাচ্ছেন। আবার জাতীয় গ্রিডেও যাচ্ছে কিছু বিদ্যুৎ।

টেকনাফের প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ চাহিদা ১৭ মেগাওয়াট। সোলার পার্ক থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমে জাতীয় গ্রিডে যায়। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টেকনাফে সরবরাহ করা হয়।

যুক্তরাজ্যের প্রোইনসোর নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জুলস পাওয়ার লিমিটেড (জেপিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রতিষ্ঠানটিকে সহযোগিতা করেছে টেকনাফ সোলারটেক এনার্জি লিমিটেড (টিএসইএল)।

>টেকনাফে গ্রাহক ৪০ হাজার। বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ মেগাওয়াট। পার্ক থেকে বিদ্যুৎ যায় জাতীয় গ্রিডে। সেখান থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায় টেকনাফ।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি। ১১৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প। জেপিএলের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, টেকনাফ আগে পেত মাত্র ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, চট্টগ্রাম থেকে। এখন সেসব সমস্যা নেই।

সৌরবিদ্যুৎ দিনের বেলায় উৎপাদন হয়। দিনে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা জাতীয়ভাবে ব্যবহার হয়। সন্ধ্যায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন জাতীয় গ্রিড থেকে এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় বলে জানান টেকনাফ পল্লী বিদ্যুতের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মিনারুল ইসলাম।

স্কুলশিক্ষক সৈয়দা তাহমিনা খানম বলেন, ‘আমার বাসায় এসি ও ফ্রিজ চলছে। বিদ্যুতের ঘন ঘন আসা–যাওয়া নেই। নির্বিঘ্নে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখাও চলছে বিদ্যুতের আলোয়।’

উপজেলার সেন্ট মার্টিন ছাড়া একটি পৌরসভা এবং পাঁচটি ইউনিয়নে এই বিদ্যুৎ পৌঁছে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মতে, বিদ্যুতের কারণে অন্ধকার থেকে মুক্তি মিলেছে। তাঁদের প্রত্যাশা, ইয়াবার ট্রানজিট এলাকাখ্যাত উপজেলাটির মাদকের অন্ধকারও এবার ঘুচতে পারে। কারণ, বিদ্যুৎ থাকলে উৎপাদনমুখী কাজ বাড়বে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, আগে মাদকের বড় চোরাচালানগুলো হতো লোডশেডিংয়ের সময়। বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন হওয়ায় এটা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, কেন্দ্রটিতে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে ৮৭ হাজার সৌর প্যানেল। প্যানেলে সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। সেই রশ্মি থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুতের আলো যাচ্ছে ঘরে ঘরে। ২০ বছর মেয়াদের এই কেন্দ্রটি চার লাখ মেট্রিক টন কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করবে।

টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সূত্র জানায়, সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করবে। সেই লক্ষ্যে রাঙামাটি, রাজশাহী, রংপুরসহ কয়েকটি স্থানে আরও সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।