প্রার্থী চেনার নতুন কায়দা

>

• মনোনয়ন ফরমে প্রার্থীর জন্য প্রশ্নমালা সাজিয়েছে আ. লীগ
• বিএনপি জোর দিয়েছে প্রার্থীর আর্থিক লেনদেনের ওপর
• বড় সব দলই প্রার্থীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করে নিচ্ছে

প্রার্থী ও তাঁর পরিবারের অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মনোনয়নের আবেদন ফরমে প্রার্থীর জন্য ‘প্রশ্নমালা’ সাজিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেখানে ১৯৭১, ১৯৭৫–পরবর্তী সময়ে প্রার্থীর পরিবারের ভূমিকা এবং গত তত্ত্বাবধায়কের সময় (ওয়ান-ইলেভেন) প্রার্থীর নিজের ভূমিকা জানতে চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি জোর দিয়েছে প্রার্থীর আর্থিক লেনদেনের ওপর। প্রার্থী ঋণখেলাপি, বিলখেলাপি কি না, এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে বিএনপি।

একই সঙ্গে বড় সব দলই প্রার্থীদের কাছ থেকে একটি করে অঙ্গীকার আদায় করে নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে একটি ‘অঙ্গীকারনামা’, বিএনপির মনোনয়ন ফরমে ‘হলফনামা’ আর জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরমে ‘ঘোষণা’ নামে পৃথক পৃষ্ঠা যুক্ত করে প্রার্থীর স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, প্রার্থী দল থেকে মনোনয়ন না পেলেও দলের হয়ে কাজ করবেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।

রাজনৈতিক দলগুলো মনোনয়ন ফরমে প্রার্থীদের আরও কিছু তথ্য চাইতে পারত বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল কি না, এটা কেউই জানতে চায়নি। নারী নির্যাতন, দখলদারি এসব অভিযোগ আছে কি না, থাকলে কী অবস্থা—এসব প্রশ্ন মনোনয়ন ফরমে থাকা উচিত ছিল। তিনি মনে করেন, নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীর হলফনামার ছকের তথ্যগুলোও মনোনয়ন ফরমে থাকতে পারত। সঙ্গে প্রার্থীরা কেন সাংসদ হতে চান, কী অবদান রাখতে পারবেন, এসব বিষয়ে এক পৃষ্ঠার একটা লেখাও থাকতে পারত। 

আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের চার পৃষ্ঠার মনোনয়ন ফরমের দাম ৩০ হাজার টাকা। মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে যুক্ত একটি অঙ্গীকারনামায় প্রার্থীর স্বাক্ষর চাওয়া হয়েছে। অঙ্গীকারনামাটি ছাপা রয়েছে, কেবল প্রার্থী তাঁর নির্বাচনী আসনের নম্বর বসিয়ে স্বাক্ষর করবেন। সেই অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রার্থী বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না বা দলীয় প্রার্থীর প্রতিকূলে কোনো কাজ করা যাবে না। অঙ্গীকারের ব্যত্যয় ঘটলে ওই প্রার্থী তাৎক্ষণিকভাবে দল থেকে বহিষ্কৃত বলে বিবেচিত হবেন।

ফরমে প্রার্থীর নাম, পরিচয়, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতার বিবরণ দিতে বলা হয়েছে। কত দিন ধরে সংগঠনে যুক্ত, ছাত্রজীবনে কোন সংগঠন করতেন, অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন কি না, কোনো যুব বা শ্রমিক বা পেশাজীবী বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না ইত্যাদি তথ্য প্রার্থীর কাছে চেয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রার্থীর পরিবারের ভূমিকা, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা–পরবর্তী পটপরিবর্তনের পরে প্রার্থীর পরিবারের ভূমিকা এবং ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে (ওয়ান-ইলেভেন) প্রার্থীর ভূমিকা জানতে চাওয়া হয়েছে ওই ফরমে। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে দলে সংস্কারপন্থী বলে পরিচিতরা মনোনয়ন দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকবেন বলে তাঁদের অনুমান।

আওয়ামী লীগের ভেতরেই এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সক্রিয় ভূমিকা ছিল, এমন কয়েকজন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ নিয়ে ফেনী-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার ফেসবুকে এ নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১১ জানুয়ারি ২০০৭–এর পরবর্তী সময়ে প্রার্থীর ভূমিকা কী ছিল? আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্রের একটি প্রশ্ন। সংস্কারবাদী ১/১১–র কুশীলবরা কে কী জবাব দিয়েছে, তা জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে।’

আওয়ামী লীগের ফরমে ওয়ান–ইলেভেনের প্রসঙ্গ টানার বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টা ইন্টারেস্টিং। ওয়ান–ইলেভেনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বলে শুনেছি। আবার তারা মনোনয়ন ফরমে এ বিষয়ে তথ্য চাইছে। আবার আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় ওয়ান–ইলেভেনকে নিজের অর্জন হিসেবেও দেখিয়েছে। এটা অতিরিক্ত যোগ্যতা না অযোগ্যতা, সেটি আমি নিশ্চিত নই।’ 

বিএনপি
আর বিএনপির দুই পৃষ্ঠার মনোনয়ন ফরমের দাম রাখা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, তবে জমা দেওয়ার ফি রাখা হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। ফরমের সঙ্গে প্রার্থীকে একটি হলফনামায় স্বাক্ষর করে বলতে হচ্ছে যে দলের ও পার্লামেন্টারি পার্টির সমস্ত আদেশ–নিষেধ প্রার্থী মেনে চলবেন। দলের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার বা সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য থাকবেন প্রার্থী। দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে দল পরিবর্তন, সংসদে আসন পরিবর্তন বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে সংঘবদ্ধ বা এককভাবে জোট গঠন করা যাবে না। সংসদে ‘ফ্লোর ক্রস’ করা যাবে না। করলে ওই প্রার্থী পদত্যাগ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন আর ওই প্রার্থীর সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে দল।

প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্যের ফরমে নাম, পরিচয় ও অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে প্রার্থী ঋণ ও বিলখেলাপি কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়েছে। আবার হলফনামাতেও প্রার্থীকে হলফ করে বলতে হচ্ছে, তিনি ঋণখেলাপি নন এবং বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব তাঁর নেই। পদে থাকা অবস্থায় প্রার্থী কোনো দুর্নীতি, অসত্য বা মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। প্রতিবছর প্রার্থী নিজের ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদের বিবরণ দলের চেয়ারপারসনের কাছে দাখিল করবেন।

দুর্নীতি না করা, ফি বছর সম্পদের বিবরণ দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমে কিছুই উল্লেখ নেই।

অতীত ও বর্তমান সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ জানতে চেয়ে যেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমে প্রায় এক পৃষ্ঠা বরাদ্দ রাখা হয়েছে; সেখানে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিতে বিএনপির ফরমে রাখা হয়েছে মাত্র দুই লাইন। তবে প্রার্থীর আগের নির্বাচনী কাজ ও সমাজসেবামূলক কাজের বিবরণ এবং সাংসদ বা মন্ত্রী হিসেবে অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়েছে। 

জাতীয় পার্টি
এক পাতার দুই পিঠে ছাপা জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরমের দাম প্রথমে ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রোববার ৩০ হাজার টাকায় মনোনয়ন ফরম কেনার পর ফরমের দাম ১০ হাজার কমিয়ে ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ করেন।

মনোনয়ন ফরমে প্রার্থীর জেলা ও নির্বাচনী এলাকার তথ্যের পরেই মনোনয়নের টাকা জমা দেওয়ার রসিদের নম্বর দিতে বলা হয়েছে, ব্র্যাকেটে বলা হয়েছে, টাকা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। এরপর প্রার্থীর নাম-পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি জাতীয় পার্টি ও অঙ্গসংগঠনে অবস্থান, অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যবিবরণী, পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য, বিশেষ গুণাবলি ইত্যাদি তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরমের শেষে প্রার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দিতে হবে। ঘোষণাটির সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পেলেও প্রার্থী পার্টিবিরোধী কোনো কাজ করবেন না এবং পার্টির মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাবেন, পূর্ণ সহযোগিতা করবেন এবং কোনো অবস্থাতেই এই সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না।

গত রোববার থেকে মনোনয়ন ফরম দিচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-ইনু)। মনোনয়ন ফরমের দাম ২ হাজার টাকা। এক পাতার এই মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে রয়েছে এক পাতার তথ্য ফরম। ওই তথ্য ফরমে প্রার্থীর এক বছরের জনসংযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, ওই আসনে সম্ভাব্য অন্য প্রার্থীদের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই আসনে বিগত তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

গতকাল থেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করেছে ইসলামী ঐক্যজোট। এক পৃষ্ঠার মনোনয়ন ফরমের দাম রাখা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। সেখানে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ও পেশাগত তথ্য চাওয়া হয়েছে।