একই পদে এত বৈষম্য!

>

• কার্যকর হচ্ছে না সুপ্রিম কোর্টের রায়
• গত ২ অক্টোবর অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের এক মাসের মধ্যে স্থায়ী করতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট

আকাশের সঙ্গে পাতালের যেমন পার্থক্য, বিমান বাংলাদেশর এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু পদেও ঠিক একই পার্থক্য। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কেবিন ক্রু হিসেবে বিমানে চাকরি পেয়েছিলেন দুই শতাধিক তরুণ। মূল বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে পেতেন ২১ হাজার টাকা। চাকরির বয়স চার পেরিয়ে পাঁচ বছর হতে চলেছে। কেবিন ক্রুর সংখ্যা কমে ১৪৫–এ নেমে এসেছে। কারণ, এসব কেবিন ক্রুর চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেবিন ক্রু জানান, ২০১৩ সালে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁদের নিয়োগ দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। ৮৫ জন তরুণীসহ মোট ২০৪ জনকে ৮৯ দিনের ভিত্তিতে অস্থায়ী কেবিন ক্রু নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের পর এসব তরুণ-তরুণীকে বিমান প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর থেকে নিয়মিত অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আকাশপথে দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা। নিয়মানুবর্তিতা, কর্মদক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কারণে ভিভিআইপি ফ্লাইটগুলোতেও রাখা হচ্ছে অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের।

গুরুদায়িত্ব দেওয়া হলেও সুবিধা ক্ষেত্রে ‘লঘু নীতি’ অনুসরণ করছে বিমান কর্তৃপক্ষ—এ কথা জানিয়ে আরেকজন অস্থায়ী কেবিন ক্রু প্রথম আলো বলেন, কেবিন ক্রু হিসেবে যাঁরা স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে অস্থায়ী কর্মীদের বেতনবৈষম্য চলছে। স্থায়ী কেবিন ক্রুদের সর্বনিম্ন বেতন ৪৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্রতিবছর তাঁদের বেতনের সঙ্গে ইনক্রিমেন্ট যোগ হচ্ছে।

স্থায়ী কর্মীরা ৬৫ ঘণ্টা টানা ফ্লাইটে থাকলেই খাবারের বিল পান ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার। অতিরিক্ত সময় হলে প্রতি ঘণ্টার জন্য আরও ১৮ ডলার সম্মানী তাঁরা পান। সপরিবারে ফ্রি বিমান টিকিট, সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতাসহ সব সুবিধাই পাচ্ছেন স্থায়ী কেবিন ক্রুরা। স্থায়ী কর্মীদের (পুরুষ) পোশাক ভাতা হিসেবে বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ও নারীদের ছয়টি শাড়ির মূল্য হিসেবে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অস্থায়ী কর্মীদের দেওয়া হয় বছরে মাত্র ৫ হাজার টাকা এবং নারীদের দুটি শাড়ির মূল্য হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দিচ্ছে বিমান কর্তৃপক্ষ।

ডিউটি রোস্টারে অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন লেখা থাকলেও তাঁদের স্ট্যান্ডবাই হিসেবে রাখা হয়। প্রয়োজনে তাঁদের ফ্লাইটে হাজির থাকতে হয়। এর জন্য ভাতা দেওয়া হয় না। শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না অস্থায়ী কেবিন ক্রুরা। তাঁদের ক্ষেত্রে নৈমিত্তিক, বার্ষিক, অসুস্থতাজনিত ও মাতৃত্বকালীন ছুটিও নেই। অসুস্থতাসহ কোনো কারণে দায়িত্ব পালন না করলে অনুপস্থিত দেখিয়ে দৈনিক ৭০০ টাকা বেতন কাটা হয়। অতিরিক্ত সময় (ওভার টাইম) কাজ করলেও পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের। হজ মৌসুমে সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হলেও তাঁরা কোনো সম্মানী ভাতা পান না। অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের ৮৯ দিন পরপর তাঁদের চাকরি নবায়ন করা হয়। কিন্তু পরিচয়পত্রে কার্ডের মেয়াদ তিন বছর উল্লেখ করে থাকে বিমান।

জানা গেছে, স্থায়ী না করায় ৫৯ জন কেবিন ক্রু চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৪৫ জন অস্থায়ী কেবিন ক্রু বিভিন্ন সময় বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের আশ্বাস পেলেও চাকরি স্থায়ী করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

এক কেবিন ক্রু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই। স্থায়ীকরণের দাবি জানালেই চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। চাকরি চলে গেলে শূন্য হাতে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বয়স চলে যাওয়ায় এখন অন্য চাকরির সুযোগও নেই।’

অস্থায়ী হিসেবে থাকা বিমানের একাধিক কেবিন ক্রু বলেন, মাসে কমপক্ষে দুবার লন্ডন ফ্লাইটে গেলে তিন দিন করে থাকতে হয়। ব্যয়বহুল এই শহরে খাবার খরচ অত্যন্ত বেশি। ৮০০ ডলার পেলেও এর পুরোটাই খরচ হয়ে যায়। প্রতি মাসে সাত দিন লন্ডনের মতো শহরে খাওয়ার খরচ জোগাড় করা বেশ মুশকিল।

স্থায়ীকরণ না হওয়ায় বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেন কেবিন ক্রুরা। এরপরও সাড়া না পাওয়ায় গত ৪ এপ্রিল বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়। এর জবাব না পাওয়ায় উচ্চ আদালতে মামলা করেন ১৩৭ জন কেবিন ক্রু। গত ২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট মামলার রায়ে অস্থায়ী কেবিন ক্রুদের এক মাসের মধ্যে চাকরি স্থায়ী করণের নির্দেশ দেন।

এই রায়ের পর ১৩৭ জন কেবিন ক্রুর চাকরি স্থায়ী করণের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বিমান কর্তৃপক্ষ। বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ ১২ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কেবল রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেয়েছি। এই কপি আমাদের আইনজীবীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’