মনোনয়নের দৌড়ে ব্যবসায়ী নেতারা

>
সালমান এফ রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণ।
সালমান এফ রহমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণ।

*দেশে ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে
*দশম সংসদের সাংসদ হওয়া ১৭৫ জনের পেশা ব্যবসা
*আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যাপক আগ্রহ ব্যবসায়ীদের
*আগামী সংসদেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্যের লক্ষণ

জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে ব্যাপক আগ্রহ ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে পরিচিত মুখগুলো এবার দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে নেমেছেন। পুরোনো অনেক ব্যবসায়ী নেতা আগে থেকেই রাজনীতির মাঠে আছেন। এবার নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন আরও অনেকে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনকে (এফবিসিসিআই) আগে থেকেই ‘সরকারের শাখা’ বলা হয়। সেই শাখা থেকে এবার বেশ কয়েকজন পরিচালক আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। সাবেক সহসভাপতি ও পরিচালকদের অনেকে এবার ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী। পণ্যভিত্তিক খাতের মধ্যে পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে একাধিক নেতা প্রধান দুই দলের ব্যানারে নির্বাচনে আগ্রহী। এর বাইরে বিভিন্ন পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠন ও জেলাভিত্তিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন জেলা চেম্বারের নেতাদের অনেক ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী।

রাজনীতির মাঠে ইতিমধ্যে পরিচিতদের অনেকের বড় ব্যবসা আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরাও এবার নির্বাচন করবেন। সব মিলিয়ে আগামী সংসদেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য থাকবে—এমন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে।

দেশে এখন ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আবার ব্যবসায়ীরা তাঁদের সংগঠনের নেতা হয়ে পরিচিতি তৈরি করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ছেন। হলফনামা বিশ্লেষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ২০১৪ সালে জানায়, দশম সংসদের সাংসদ হওয়া ১৭৫ জনের পেশা ব্যবসা। ফলে সংসদে ব্যবসায়ীদের হার ৫০ শতাংশ।

সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মেয়র ও সাংসদ হয়েছেন তারকা ব্যবসায়ীরা, যাঁরা আগে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। এর মধ্যে রয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি প্রয়াত আনিসুল হক ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। যদিও ওই নির্বাচন স্থগিত রয়েছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে—টাকাওয়ালা বড় বড় ব্যবসায়ী নির্বাচন করবেন। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও নির্বাচনে যাচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। এতে করে যে অবস্থা তৈরি হচ্ছে, তাতে সমাজের ভালো মানুষ, কিন্তু যাঁদের অনেক অর্থবিত্ত নেই, তাঁদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথটি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এটি ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’

এফবিসিসিআই
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতিদের মধ্যে তিনজন এবার নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। এর মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত–বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান (ঢাকা-১) ও ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণ (কুমিল্লা-৩)। আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু (ফেনী-৩) বিএনপি থেকে নির্বাচনে যাচ্ছেন।

এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান দুই সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম ও মুনতাকিম আশরাফ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে তাঁরা এবার নির্বাচন করছেন না। মুনতাকিম আশরাফের বাবা সাবেক ডেপুটি স্পিকার মো. আলী আশরাফ ও ফজলে ফাহিমের বাবা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবারও নির্বাচনে অংশ নেবেন।

অবশ্য এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান সদস্যদের মধ্যে এবার অন্তত ১১ জন ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী। এর মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগ থেকে শমী কায়সার (ফেনী-৩), কাজী ইরতেজা হাসান (ঢাকা-১৭), আবু নাসের (টাঙ্গাইল), দিলীপ কুমার আগারওয়ালা (চুয়াডাঙ্গা-১), আনোয়ার সাদাত সরকার (গাজীপুর), রেজাউল করিম (জামালপুর-৫), তাবারুকুল তোসাদ্দেক হোসেন খান (মানিকগঞ্জ-৩), খায়রুল হুদা (সুনামগঞ্জ-১) ও মাসুদ পারভেজ খান (কুমিল্লা-৬)।

বর্তমান পরিচালকদের মধ্যে বিএনপি থেকে ভোটে অংশ নিতে চান আবু মোতালেব (ঢাকা-৭)।
এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মো. হেলাল উদ্দিন (নরসিংদী-৪), আমিনুল হক শামীম (ময়মনসিংহ সদর-৪) ও বিএনপি থেকে আবদুল ওয়াহেদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩) নির্বাচনে আগ্রহী।

পোশাক খাত
চলতি সংসদের কমপক্ষে ৩০ জন সাংসদ পোশাক খাতের ব্যবসায়ী। এবারও তাঁরা নির্বাচনে আগ্রহী। এর বাইরে যোগ হচ্ছে নতুন মুখ।
তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর প্রায় দুই ডজন সাবেক ও বর্তমান নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন ব্যবসায়ীও আছেন।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গত সেপ্টেম্বরে উপনির্বাচনে খুলনা-৪ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সাংসদ হন। তবে এখন আবার তাঁকে ভোটে দাঁড়াতে হচ্ছে। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি সাংসদ টিপু মুনশি আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত (রংপুর-৪)। বিজিএমইএর এখনকার তিনজন সহসভাপতি আওয়ামী লীগ থেকে ও একজন বিএনপি থেকে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগ থেকে মঈনউদ্দিন আহমেদ (চট্টগ্রাম-১০), এস এম মান্নান কচি (ঢাকা-১৬) ও মোহাম্মদ নাছির (চট্টগ্রাম-১২) এবং বিএনপি থেকে মাহমুদ হাসান খান (চুয়াডাঙ্গা-২)।

পোশাক খাতের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি জাতীয় পার্টির সেলিম ওসমান বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ। একই সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি আসলাম সানি (নরসিংদী-৪) ও বর্তমান পরিচালক নুরুল আলম চৌধুরী (মুন্সিগঞ্জ-১) আওয়ামী লীগ থেকে ভোটে অংশ নিতে আগ্রহী।

পোশাক খাতের কিছু ব্যবসায়ী বিএনপি থেকেও ভোটে অংশ নিতে চান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এস এম ফজলুল হক (নারায়ণগঞ্জ)। এ ছাড়া জাকারিয়া তাহের (কুমিল্লা-৮), আবুল কালাম আজাদ (কুমিল্লা-৯), খালেদ মাহবুব (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩) লুৎফর রহমান (টাঙ্গাইল-৪)।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান
ব্যাংক, বিমা ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২০ জন পরিচালক এ বছর নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। ফরিদপুর-১ (আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও মধুখালী) আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন। একই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন প্রাইম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক কাজী সিরাজুল ইসলাম।

নোয়াখালী-২ (সেনবাগ, সোনাইমুড়ী) আসনের সাংসদ, আওয়ামী লীগের মোরশেদুল আলম মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক। ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল ঢাকার যেকোনো একটি আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

অন্যান্য
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে সোনা ব্যবসায়ী দিলীপ কুমার আগরওয়ালা (চুয়াডাঙ্গা-২) মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন, যিনি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক। একই সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী সিরাজুল ইসলাম ফরিদপুর-১ থেকে নির্বাচন করতে চান। একই আসনে সাবেক সভাপতি দিলীপ রায়ও ভোটে দাঁড়াতে চান।

এ ছাড়া বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি সেলিমা আহমাদ কুমিল্লা-২ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর স্বামী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মাতলুব আহমাদ।

জাতীয়ভাবে পরিচিত অনেক শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারেরাও নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে রয়েছেন তমা কনস্ট্রাকশনের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূঁইয়া (নোয়াখালী-২) এবং বিএনপি থেকে বারাকা পাওয়ারের চেয়ারম্যান ফয়সল আহমেদ চৌধুরী (সিলেট-৬)।