বিক্ষোভের মুখে স্থগিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, সারা দিনের চেষ্টার পর একজনও রাজি নয়

মিয়ানমারের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া। প্রথম আলো ফাইল ছবি
মিয়ানমারের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া। প্রথম আলো ফাইল ছবি

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিক্ষোভের মুখে স্থগিত হয়ে গেল প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। আজ বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় ৩০ পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখে এক কথা ‘আঁরা বর্মাত ন যাইয়ুম’ (অর্থাৎ আমরা বার্মায় ফিরে যাব না)।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণের জন্য ওপারে (রাখাইন রাজ্যের তুমব্রু) মিয়ানমারের একজন মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার পর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়ে দেন, সরকারের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হলো না। কখন হবে, তা–ও তিনি নির্দিষ্ট করে বলেননি।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজারে আরআরআরসি মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেছিলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাবাসনের অনুকূলে নয়। টেকনাফের ২২ নম্বর ক্যাম্প টেকনাফের উনচিপ্রাংয়ে রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলব। তারা স্বেচ্ছায় যেতে চাইলে প্রত্যাবাসন শুরু হবে দিনের যেকোনো সময়। ওদিকে মিয়ানমারও প্রস্তুত আছে।

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে পাঁচটি বাস ও তিনটি ট্রাক নিয়ে আরআরআরসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উনচিপ্রাং ক্যাম্পে যান। এই ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের জন্য আগে থেকে প্রায় ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাদের রাখা হয় একটি ত্রাণকেন্দ্রে। সেখানে রোহিঙ্গাদের তিন দিনের খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য, নগদ অর্থ এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু একজন রোহিঙ্গাও স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হয়নি।

বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রোহিঙ্গাদের গাড়িতে ওঠার অনুরোধ করা হলে ‘আঁরা বর্মাত ন যাইয়ুম’ বলে চিৎকার করতে থাকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এরপর আশপাশের ক্যাম্প থেকে হাজারো রোহিঙ্গা ঘটনাস্থলে এসে প্রত্যাবাসনবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। বেলা সোয়া দুইটা পর্যন্ত চলে এই বিক্ষোভ। বিক্ষোভে হ্যান্ড মাইকে স্লোগান ধরেন রোহিঙ্গা নেতা খাইরুল আমিন। স্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ এবং ‘আঁরা বর্মাত ন যাইয়ুম’। সেখানে র‍্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্য মোতায়েন ছিলেন।

বিক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে রোহিঙ্গা নেতা খাইরুল আমিন বলেন, রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া গণহত্যা, ধর্ষণ, আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস ও সম্পদ লুটপাটের বিচার হয়নি। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ও নাগরিকত্ব প্রদানের আগাম ঘোষণা না পাওয়া পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে ফিরে যাবে না। জোর করে ফেরত পাঠালে তা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন।

বেলা সোয়া দুইটার দিকে আরআরআরসি আবুল কালাম ক্যাম্প ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘উনচিপ্রাং ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায়—এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। এখন অন্য একটি ক্যাম্পে যাচ্ছি। যারা ফিরে যেতে চায়, তাদের জন্য বিকেল ৪টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে।’ পরে বিকেল সোয়া ৪টায় আবুল কালাম বলেন, স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি না হওয়ায় আজকের প্রথম দফার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।

আবুল কালাম আরও বলেন, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা ছিল। প্রত্যাবাসনের জন্য উভয় দেশই প্রস্তুত ছিল। বাংলাদেশ সরকার সারা দিন চেষ্টা চালায়। কিন্তু রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে রাজি হয়নি।

ফাঁকা দুটি ট্রানজিট ঘাট
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি ট্রানজিট ঘরটি ফাঁকা ছিল। সেখানে কয়েকজন বিজিবি সদস্য টহল দিচ্ছেন। তবে নির্ধারিত ঘরে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিল না। এই ট্রানজিট ঘাট হয়ে স্থলপথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতুর ওপর দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বেলা তিনটার দিকে মিয়ানমারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা মৈত্রী সেতুর মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে তাঁদের উপস্থিতি জানান দেন এবং কয়েক মিনিট পর তাঁরা ফের তাঁদের সীমান্ত চৌকিতে ফিরে যান। বিকেল চারটার পর তাঁরা রাখাইন রাজ্যের মংডুতে ফিরে যান।

একই অবস্থা ছিল টেকনাফের কেরুনতলীর ট্রানজিট ঘাটের। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সেখানে কয়েকজন আনসার সদস্য ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। সেখানে ছিল না কোনো রোহিঙ্গা। ঘাটের পাশে নাফ নদীতেও দেখা যায়নি পারাপারের কোনো নৌকা অথবা ট্রলার। প্রত্যাবাসন করতে হলে এখান থেকে নৌকা নিয়ে পাঁচ কিলোমিটার নদী পার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে নিতে হতো।

উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪। এর মধ্যে গত বছরের ২৫ আগস্টের পরই এসেছে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী।