বিরোধ যেখানে প্রকাশ্য

সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৫ আসন বরাবরই আওয়ামীবিরোধীদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ ও ২০১৪ সালে আসনটি আওয়ামী লীগ পায়। দ্বিতীয় থেকে নবম জাতীয় সংসদের বাকি আটটি নির্বাচনে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের প্রার্থী এখানে বিজয়ী হন।

২০০১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন চারদলীয় জোট ২৯৯ আসনে ভাগাভাগি করে প্রার্থী দিয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম-১৫ বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। ওই নির্বাচনে জামায়াতের শাহজাহান চৌধুরী বিএনপির তৎকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে হারিয়ে দেন। এ কারণে অলি আহমদের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বাড়ে। একপর্যায়ে বিএনপি ছেড়ে নতুন দল এলডিপি গঠন করেন অলি। এ ছাড়া এখানে বিএনপিও জামায়াতকে আস্থায় নিতে পারেনি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের ১৮ জন ফরম কিনেছেন। বিএনপির ফরম কিনেছেন সাতজন। জামায়াতের কারাবন্দী সাবেক দুই সাংসদ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী সাংসদ নির্বাচিত হন। অবশ্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিষ্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) প্রার্থী জয়নাল আবেদীন কাদেরী। 

এই আসনের বর্তমান সাংসদ আবু রেজা নদভীর সঙ্গে দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর বিরোধ রয়েছে। আবার বিএনপিতে রয়েছে দ্বন্দ্ব। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের সঙ্গেও রয়েছে বিএনপির দূরত্ব। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জামায়াতের সাবেক দুই সাংসদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য।

নৌকার মাঝি ১৮
এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৮ জন ফরম কিনেছেন। তবে প্রচারণার মধ্যে আছেন সাতজন। তাঁরা হলেন বর্তমান সাংসদ আবু রেজা নদভী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং রূপালী ব্যাংকের পরিচালক আবু সুফিয়ান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং জেলা পিপি এ কে এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান।
সাংসদ আবু রেজা নদভী বলেন, ‘আমি সপ্তাহে কমপক্ষে তিন দিন সংসদীয় এলাকায় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষকে সময় দিচ্ছি। স্বাধীনতার পর সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় কোনো সাংসদ আমার মতো এলাকায় উন্নয়ন করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী আমার মাধ্যমেই দুই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করিয়েছেন। তা ছাড়া, আমি ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি।’
সাংসদ নদভীর আত্মীয়–স্বজনেরা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে আওয়ামী লীগের অনেকেই তাঁকে মেনে নিতে পারছেন না। আবার আওয়ামী লীগের যাঁরা আছেন, তাঁরাও ঐক্যবদ্ধ নন।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির উপপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনীতি করে আসছি। এলাকার মানুষ মনে করছে, আমার মনোনয়ন পাওয়া উচিত।’
রূপালী ব্যাংকের পরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, ‘২০১৪ সালে মনোনয়ন চেয়েছি। এবার আবার চাইব।’
সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ব্যবসায়ী এম এ মোতালেব বলেন, ‘নদভী সাংসদ হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখেননি। তাঁর ডাকা সভা-সমাবেশেও আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় না।’
স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘২০১৪ সালে কঠিন সময়ে আমি নদভীর জন্য কাজ করে তাঁকে সাংসদ নির্বাচিত করতে ভূমিকা রেখেছি। কিন্তু সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাংসদের যে সমন্বয় হওয়ার দরকার ছিল, তা হয়নি।’

বিএনপিতে দ্বন্দ্ব
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় বিএনপি তিন ধারায় বিভক্ত। এখানে বিএনপির সাতজন ফরম কিনেছেন। তবে প্রচারে আছেন চারজন। বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার আশায় ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন লাগিয়ে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন তাঁরা। এই চারজন হলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক নাজমুল মোস্তফা আমিন ও যুগ্ম সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এখানে বিএনপির কর্মসূচি পালিত হয় না। হামলা-মামলার ভয়ে সবাই নীরব। দলীয় কোন্দলের কারণে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নির্বাচনী এলাকায় ভালো অবস্থান নেই।
নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, ২০–দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে জামায়াত এ আসনে নির্বাচন করলেও বিএনপির সমর্থকদের ভোট পাবেন না। কারণ, জামায়াতের সঙ্গে এখানে বিএনপির সমঝোতা নেই।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সহসভাপতি শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘দলের সবুজ সংকেত পেয়ে এলাকায় কাজ করছি।’ দলে দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, বড় দলে এটা স্বাভাবিক বিষয়।
সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘রাজনীতি করতে গিয়ে একাধিকবার কারাবরণ করেছি।’ তিনি বলেন, স্থানীয় বিএনপির ভোটাররা জামায়াতের পক্ষে কখনোই ছিল না। দ্বন্দ্বের কারণে জামায়াতের আগের অবস্থান আর নেই।

জামায়াতে দ্বন্দ্ব
১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আসনটিতে জামায়াতের শাহজাহান চৌধুরী বিজয়ী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন জামায়াতের আ ন ম শামসুল ইসলাম। সম্প্রতি কেন্দ্র থেকে আ ন ম শামসুল ইসলামকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে শাহজাহান চৌধুরীকেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণার দাবি জানানো হচ্ছে। তা ছাড়া, এই দুই সাবেক সাংসদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে।
জামায়াতের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানান, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনটি শাহজাহান চৌধুরীর হাতে গড়া। এ আসনে তাঁর মনোনয়ন পাওয়া উচিত। শামসুল ইসলাম নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতেই শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন বলে তাঁদের দাবি। এই আসনে নির্বাচন করতে তাঁরা দুজনই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার আমির জাফর সাদেক বলেন, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে আ ন ম শামসুল ইসলামই চূড়ান্ত। শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম নগরের একটি আসনে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে।