সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ার আহ্বান

জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ বৃহস্পতিবার সকালে ‘বাংলাদেশে মি টু আন্দোলন, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা। ছবি: ফোকাস বাংলা
জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ বৃহস্পতিবার সকালে ‘বাংলাদেশে মি টু আন্দোলন, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা সভায় বক্তারা। ছবি: ফোকাস বাংলা

হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনে সামাজিক শক্তি রাখতে হবে। এ আন্দোলনকে ফ্যাশন হিসেবে না নিয়ে কাঠামোগতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দ্রুত আইন কার্যকর করতে হবে। এ জন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ার আহ্বান জানানো হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে মি টু আন্দোলন, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা সভায় এ আহ্বান জানানো হয়।

আলোচনা সভা থেকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত নয়জন নারী নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। আজকের সভায় এ রকম তিনজন নারী-জাকিয়া সুলতানা মুক্তা, মুশফিকা লাইজু ও তাশনুভা আনান নিজেদের অভিজ্ঞতা শোনান। তাঁরা জানান, সারা বিশ্বে হ্যাশট্যাগ মি টু হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এ আন্দোলন বাংলাদেশে আসার পর তাঁরাও মুখ খোলার সাহস পেয়েছেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা জানানোর পর দীর্ঘদিন বয়ে বেড়ানো ট্রমা থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে জানান।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাকিয়া সুলতানা বলেন, এ ধরনের ঘটনা নারীকে পিছিয়ে দেয়। তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ধরনে বিষয় প্রকাশ পাওয়ার পর নানাভাবে হুমকি ও সমঝোতার প্রস্তাব পেয়েছেন। সমাজের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সমাজে যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁরা ঠিক করবেন যে নারীর ওপর দিয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে, তা আমাদের সমাজকে কতটুকু পিছিয়ে দেয়; কীভাবে এগুলো হ্যান্ডল করলে সমাজ সুন্দর হয়।’

ভুক্তভোগীরা জানান, মেয়েরা ঘটনাগুলো প্রকাশ করলে সমাজে মেয়েদের খারাপ বা অপরাধী হিসেবে দেখা হয়। জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘অনেকেই বলে এত দিন পরে কেন, কিন্তু আগে হলেও কি বিচারটা নিতেন?’ তিনি আরও বলেন, হ্যাশট্যাগ মি টু ঘটনা প্রকাশ করার সময়ে তিনি তাঁর স্বামীকে পাশে পেয়েছেন। এ ছাড়া তরুণ প্রজন্মও তাঁকে সমর্থন করেছেন।

তবে জাকিয়ার প্রতি সমর্থন থাকলেও রূপান্তরিত নারী (ট্রান্সজেন্ডার) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনার কর্মকর্তা তাশনুভা আনান ছয় বছর ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং কারও সমর্থন পাননি। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের ওপর এই মুহূর্তে যদি কোনো প্রভাব পড়ে, তাঁদের মধ্যে কী পরিমাণ ট্রমা যাবে তা নিয়ে আমি সত্যি চিন্তিত।’

হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলনের পাশাপাশি নিপীড়কদের ‘ক্ষমা চাই’ আন্দোলনও শুরু করতে হবে বলে মনে করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজা। তিনি বলেন, ‘মি টু আসলে কী চায়। আসেন, যারা ভুল করেছেন, তারা ভুল স্বীকার করেন এবং নতুন করে যাতে এই ভুলে জড়িয়ে না পড়েন, সাহস না পান সেই জায়গাটা তৈরি করা।’

মি টু আন্দোলনের দুটি দিক খুব বেশি দেখা যাচ্ছে উল্লেখ করে মাসুম রেজা বলেন, মি টু প্রকাশ হওয়ার পর একটি দল খুব উৎসাহী হয়ে নাম উল্লেখ করে বলে দেয় কার কার মি টু দেখা যাবে। আরেকটি দল কারও বিরুদ্ধে মি টু প্রকাশ হওয়ার পর অতি প্রতিক্রিয়া দেখায়। তিনি বলেন, এখানে অভিযুক্তকেও জায়গা দিতে হবে। নয়তো তা মি টু আন্দোলনের জন্যই ক্ষতি হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক বলেন, হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণাও আছে। মি টু নিয়ে আলোচনা জরুরি। তিনি বলেন, ‘মি টু আন্দোলনের প্রধান বিষয় হচ্ছে একে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জায়গায় অ্যাড্রেস করা।’ তিনি আরও বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার কারণেই আইনি সহায়তা থাকার পরও পরিবর্তন আসছে না। নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে এই মি টু আন্দোলন আরও ভূমিকা রাখবে।

যৌন হয়রানি আন্দোলন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এবং নারীর যে ব্যক্তি অধিকার আছে তা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ শেখায় না বলে মন্তব্য করেন মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম। তিনি বলেন, সামাজিক শক্তি রাখতে হবে। পরিবার, সমাজ ও সিলেবাসে এসব বিষয় তুলে ধরতে হবে। যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে আয়শা খানম বলেন, মনের মধ্যে শক্তি রাখবেন। এই আন্দোলন কোনো পুরুষের বিরুদ্ধে না, এটা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে; যারা নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখে। চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রকাশের ভাষা যেন এমন না হয় যেখানে নিজেদের দ্বিতীয়বার হয়রানি করা হয়, যাতে অন্য কেউ সুযোগ না নিতে পারেন। এই আন্দোলনকে ফ্যাশন হিসেবে না নিয়ে একে কাঠামোগতভাবে এগিয়ে নিতে হবে।

অভিযুক্ত ব্যক্তির কর্মস্থলে থাকার বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন, যিনি অভিযোগ করেছেন, তার জন্য ভীতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ হয় তাহলে সরিয়ে রাখা যায়। শাস্তি নয়, নিরাপত্তার জন্য। যার মাধ্যমে ঘটনা ঘটেছে তার যদি তদন্তে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকে তাহলে ওই সময়ের জন্য বরখাস্ত করে রাখা যেতে পারে।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নীতিমালা ও আইন করার কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কাবেরী গায়েন। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, বতর্মান আইনের মধ্য থেকেও এই বিষয়গুলোতে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রয়োগেই গলদ রয়ে গেছে। কর্মস্থলে নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। হ্যাশট্যাগ মি টু তে যেভাবে মেয়েরা এগিয়ে আসছে, তা ধরে রাখতে হবে। ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সকল প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী কর্মস্থলে কমিটি গঠন করার কথাও বলেন।

আইন করার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি, নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল জানাসহ যৌন হয়রানির ঘটনায় অভিযুক্তকে ঘটনা প্রমাণ করার সামাজিক চাপ তৈরি করার আহ্বান জানানো হয় গোলটেবিল আলোচনা থেকে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে করা রায়কে দ্রুত আইনে বাস্তবায়ন করার দাবিও জানানো হয়েছে।

গোলটেবিলে দেশ ইনফো ডটকমের সাংবাদিক সাজেদা হকের সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, বাংলাভিশনের বার্তা সম্পাদক মাসুদ কামাল, আইনজীবী ওহিদুর রহমান, বাংলা ট্রিবিউনের বার্তা প্রধান হারুন উর রশীদ, এটিএন বাংলার সাংবাদিক নাদিরা কিরণ, প্রথম আলোর বার্তা বিভাগের পরামর্শক কুররাতুল আইন তাহমিনা প্রমুখ।