৫ কেজি হেরোইন হয়ে গেল 'বাদামি গুঁড়া'

>
  • হেরোইনের নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাল্টে ‘বাদামি গুঁড়া পদার্থ’ লিখে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
  • উড়ো ফোনের সূত্র ধরে রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন বদলের এই চিত্র পাওয়া গেল।
  • এর সঙ্গে কিছু অসাধু পুলিশ, আইনজীবী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে।

মো. সাজেমানকে (৩৭) পাঁচ কেজি হেরোইনসহ আটকের পর রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় একটি মামলা করেছিল র‍্যাব। নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে হেরোইনের অস্তিত্ব না পাওয়ায় গত জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এর মাস দুয়েক পর গত মার্চে একটি উড়ো ফোনকল পান রাজশাহীর পুলিশ সুপার। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, পাঁচ কেজি হেরোইন উদ্ধারের মামলাটির কী হলো, দেখবেন।
এই ফোনের সূত্র ধরে মামলাটির খোঁজ নেন পুলিশ সুপার। মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করতে আদালতের অনুমতি নিয়ে গঠন করেন তদন্ত কমিটি। তদন্তে হেরোইনের নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পাল্টানোর একটি চক্রের সন্ধান পায় কমিটি। এর সঙ্গে কিছু অসাধু পুলিশ, আইনজীবী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে পুলিশ মনে করছে।
মাদক পাচারের রুট হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর গোদাগাড়ী অঞ্চলে প্রায়ই এমন হেরোইন উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার সঠিক প্রতিবেদনের অভাবে মাদক কারবারে জড়িত ব্যক্তিরা ছাড়া পেয়ে যান বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর র‍্যাব-৫–এর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে গোদাগাড়ী থানায় মামলাটি করেন। এই মামলায় মো. সাজেমান (৩৭) ও মো. আলম (৪৫) নামের দুই ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তাঁদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রাজ্জাক (নিরস্ত্র) জব্দকৃত আলামত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠান। তাঁর বদলিজনিত কারণে গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলতাব হোসেন তদন্তভার পান এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
উড়ো ফোন পাওয়ার পর রাজশাহীর বর্তমান পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ জেলা বিশেষ শাখার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দেন। এই কমিটি গত ২৯ মে পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়েছে, কমিটির সদস্যরা গত ৬ ও ৭ মে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রেজিস্টার পর্যালোচনা করেন। তাতে দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১টি খামে ৩২টি পুলি পুরিয়ায় মোট প্রাপ্ত ৬৩ দশমিক ৮৫ গ্রাম বাদামি গুঁড়া পদার্থে “হেরোইন” পাওয়া গিয়াছে, সিলমোহর অক্ষত ছিল।’ দুই পাতার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে বিধি অনুযায়ী প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক তাতে প্রতিস্বাক্ষর করেন। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রতিবেদনটি গোদাগাড়ী মডেল থানার ওসি বরাবর পাঠানো হয়। গোদাগাড়ী থানায় প্রতিবেদনটি প্রাপ্তি দেখানো হয়েছে ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর। যদিও তা রেজিস্টারে তোলা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১টি খামে ৩২টি পুলি পুরিয়ায় মোট প্রাপ্ত ৬৩ দশমিক ৮৫ গ্রাম বাদামি গুঁড়া পদার্থে “হেরোইন” পাওয়া যায় নাই, সিলমোহর অক্ষত ছিল।’ প্রতিবেদনে শুধু পরীক্ষক আবু হাসান ও প্রধান পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহার প্রতিস্বাক্ষর রয়েছে। অথচ এতে দুজন পরীক্ষকসহ তিনজনের স্বাক্ষর থাকার কথা। এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী প্রথমবার ‘নেগেটিভ রিপোর্ট’ হলে অধিদপ্তর থেকে পুনরায় আলামত চাওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।


তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অসংগতিগুলো থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সীর আমলে না নেওয়ার বিষয়টি বোধগম্য নয়। ওসি বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে কর্তব্যে চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিবেদনটি নিজের কাছে রেখে পাঁচ দিন পর তদন্ত কর্মকর্তাকে দিয়েছেন। এটিও কর্তব্যে অবহেলার শামিল। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তা আলতাব হোসেনের বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি গত ২৩ জানুয়ারি এভাবেই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, তদন্ত দলের কাছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নৈশপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আবদুর রাজ্জাক এই প্রতিবেদন নিয়ে তদবির করেছিলেন। প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহার সামনেই আবদুর রাজ্জাক এ কথা বলেছেন।


তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলাটি গোদাগাড়ী থানার বর্তমান ওসি জাহাঙ্গীর আলমকে মামলাটির পুনরায় তদন্ত করতে দেওয়া হয়। তিনি গত অক্টোবরে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।


হিপজুর আলম মুন্সী বর্তমানে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানায় কর্মরত। যোগাযোগ করা হলে ৬ নভেম্বর তিনি বলেন, তিনি চলে আসার পর মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন দিতে বিলম্বের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিলম্ব করলেও তিনি তো প্রতিবেদনের স্বাক্ষর পরিবর্তন করতে পারেন না। তিনি দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আলতাব হোসেন গোদাগাড়ী থানায় নেই। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।


দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, তাঁরা ‘পজিটিভ রিপোর্ট’ দিয়েছেন অথচ আদালতে ‘নেগেটিভ রিপোর্ট’ উপস্থাপন করা হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে বিষয়টি শুনে তিনিই বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানিয়েছিলেন। তারপর তাঁরা তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁদের কার্যালয়ের নৈশপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলায় তাঁকে বদলি করা হয়েছে।


এসআই আবদুর রাজ্জাককে ৬ নভেম্বর শিল্পাঞ্চল পুলিশে বদলি করা হয়েছে। মামলার আলামত নষ্ট করার ব্যাপারে তিনি বলেন, তিনি ওই রাজ্জাককে চেনেন না। তাঁর সঙ্গে কোনো পরিচয়ও নেই। তাঁকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হলে তিনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করবেন।