বিক্ষুব্ধদের ঠিকানা ঐক্যফ্রন্ট-যুক্তফ্রন্ট

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের কোন্দল ও মনোনয়নবঞ্চিতদের দলত্যাগ ঠেকাতে তৎপর আছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। মনোনয়নের বিষয়টি স্পষ্ট হলে অনেকেই দল ত্যাগ করে ঐক্যফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্টের শরিক দলে যোগ দিতে পারেন। এ আশঙ্কায় বড় দুই দল ও জোটের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হচ্ছে গোপনীয়তার মধ্যে।

দীর্ঘদিন ধরে নিজ দলে কোণঠাসা ছিলেন এমন কেউ কেউ ইতিমধ্যে দল বদল করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক জোট ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মিত্র যুক্তফ্রন্টের শরিক দলে যোগ দিয়েছেন।
চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ হলে আরও অনেকে দল বদল করতে পারেন, এমন আশঙ্কা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেই আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত ও বিক্ষুব্ধরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরাম বা নাগরিক ঐক্যে যোগ দিতে পারেন। বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতরা যেতে পারেন এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের মূল দল বিকল্পধারা বাংলাদেশে।

বিএনপি থেকে যুক্তফ্রন্টে
বিএনপি থেকে অবসর নেওয়া সমশের মবিন চৌধুরী এবং বিএনপির সাবেক সাংসদ এম এম শাহীন যোগ দিয়েছেন যুক্তফ্রন্টের প্রধান দল বিকল্পধারায়। এম এম শাহীনের নির্বাচনী এলাকা মৌলভীবাজার-২। সেখান থেকে ঐক্যফ্রন্টের সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। তাই দল ত্যাগ করে যুক্তফ্রন্টে গেছেন শাহীন। আওয়ামী লীগ এই আসন যুক্তফ্রন্টকে ছেড়ে দিতে পারে। এরশাদ সরকারের সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী গোলাম সারোয়ার মিলন ও নাজিম উদ্দিন আল আজাদ এবং জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ গোলাম রেজা এবং সর্বশেষ গত রোববার সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম চৌধুরী যোগ দিয়েছেন বিকল্পধারায়।
২০-দলীয় জোট ছেড়ে দুটি দল যোগ দিয়েছে যুক্তফ্রন্টে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের আসন সমঝোতা হচ্ছে। এমন অভিযোগও আছে যে বিএনপি থেকে নেতাদের বের করে যুক্তফ্রন্ট বা বিকল্পধারায় আনার জন্য সরকারি মহল থেকে তৎপরতা আছে। এর মধ্যে বিএনপিতে সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিতদের প্রতি নজর বেশি বলে জানা গেছে।
অবশ্য যুক্তফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং বিকল্পধারার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সমশের মবিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের আগে দলবদলের জন্য সময় আর বেশি নেই। নতুন কেউ আসতে চাইলেই নেওয়া হবে না। ব্যক্তি হিসেবে তাঁর নীতি ও আদর্শ বিবেচনা করে দেখা হবে।

আওয়ামী লীগ থেকে ঐক্যফ্রন্টে
ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন এবং শীর্ষস্থানীয় আরেক নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না দুজনেই একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। তাই আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ বা বঞ্চিতদের আগ্রহ এ দুই দলের প্রতি। ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আওয়ামী লীগে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর যোগ দিয়েছেন ড. কামালের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায়। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন গণফোরামে। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এস এম আকরাম পদত্যাগ করার কয়েক বছর পর যোগ দেন নাগরিক ঐক্যে। জাপার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি চাঁদপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল হক সম্প্রতি যোগ দিয়েছেন নাগরিক ঐক্যে। তাঁরা সবাই ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নপ্রত্যাশী।
ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন পেতে গণফোরাম ও নাগরিক ঐক্যের কার্যালয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন নেতা ও সাবেক আমলা যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কেউ দলে যোগ দিতে আসতেই পারেন, কিন্তু তাঁকে ঐক্যফ্রন্টের প্রতীকের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে না। তবে যদি কেউ যোগ্য ও জনপ্রিয় হন, তাহলে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে।

কৌশলী বিএনপি ও আওয়ামী লীগ
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দল ঠেকাতে অনেক আগে থেকেই তৎপরতা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহী প্রার্থী না হতে বারবার সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে। মনোনয়ন তালিকা প্রকাশে গোপনীয়তা অবলম্বন করছে তারা। এ ছাড়া দলের মনোনয়ন ফরম তোলা সবাইকে গণভবনে ডেকে সতর্ক করে দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়ে দেন, দলের কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।
দলত্যাগ বা বিদ্রোহ ঠেকাতে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে বিএনপিও। প্রতি আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের একত্র করে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় দলের দুর্দিনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে সবাইকে দলের মনোনীত ধরে এলাকায় কাজ করার কথা বলা হয়।

আসনপ্রতি বিএনপির ১৫, আ.লীগের ১৩
বিএনপির মোট মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৫৮০টি আর আওয়ামী লীগের ৪ হাজার ৬৩টি। গড়ে আসনপ্রতি বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৫ জন, আওয়ামী লীগের ১৩ জন এবং আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতি আসনে আগ্রহী আছেন প্রায় ১০ জন। জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতা ও মনোনয়নের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বড় দুই দলকে।
অনেক রাজনীতিক মনে করছেন, সরকার বা বিরোধী জোটের ছোট শরিক দলে যোগ দিলে মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই অনেক আগ্রহী প্রার্থী ঐক্যফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্টের শরিক ছোট ছোট দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নতুন কৌশলও দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম তোলার পর আকস্মিকভাবে জাপায় যোগ দিয়ে নতুন করে ফরম তুলেছেন এক-এগারোর সময় আলোচিত সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। জাপা থেকে মহাজোটের প্রার্থী হতে পারেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিতে এখন আর নীতি-আদর্শের বালাই নেই। সাংসদ হওয়ার আকর্ষণ থেকেই নিজের সুযোগ তৈরি করে নিতে দলবদলের দৌড়ঝাঁপ চলছে।