ওদের জন্য চাই সমন্বিত উদ্যোগ

গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতা করছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ।  প্রথম আলো
গোলটেবিল আলোচনায় বক্তৃতা করছেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। পাশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। প্রথম আলো

দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী। কিশোরীদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। শহরের বিবাহিত কিশোরীদের প্রায় ৪৬ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করে না। বস্তির ৪৪ শতাংশ বিবাহিত কিশোরী ১৯ বছর বয়সেই মা হচ্ছেন। তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সঠিক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সমন্বিত কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন।

গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘শহরকেন্দ্রিক কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন-স্বাস্থ্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতা করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

মূল উপস্থাপনায় ইউএনএফপিএর ঢাকা কার্যালয়ের কর্মসূচি বিশ্লেষক মুহাম্মদ মুনির হোসেন বলেন, ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিতদের ৩১ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। এদের মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্যজনিত জটিলতা সম্পর্কে ধারণা প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের তুলনায় কম। কিশোরী মায়েদের ৬০ শতাংশের প্রসব হয় বাড়িতে এবং এদের ৫০ শতাংশ প্রসবের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পায় না।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার বলেন, কৈশোর বয়সের স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সবাইকে অনুধাবন করতে হবে এবং তাদের সমস্যা নিয়ে সবাইকে মুখ খুলতে হবে। তিনি বলেন, গ্রামের তুলনায় শহরের কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে স্বাস্থ্য উদ্যোগ কম। অথচ শহরের কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।

ইউনাইটেড নেশনস ইউথ অ্যাসোসিয়েশন কর্মসূচির সদস্য আনিকা শাহজাবিন বলেন, শহরের বাবা-মায়েরা ব্যস্ত থাকেন। কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক বা মানসিক জটিলতা নিয়ে স্কুলেও কথা বলতে পারে না। কিশোর-কিশোরীর সমস্যা বলার বা শোনার মঞ্চ দরকার।

অনুষ্ঠানে হলি ক্রস গার্লস হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসা মেহরিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য ভুল না ঠিক, তা যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে না কিশোর-কিশোরীরা। দারুণ নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী জোনায়দুল ইসলাম বলেন, স্কুলে প্রজনন–স্বাস্থ্য বিষয়ে মাসে একটি বা দুটো ক্লাস হতে পারে। তেজগাঁও সরকারি গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রেবেকা সুলতানা বলেন, মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় সহায়তা দিতে প্রতিটি স্কুলে কাউন্সেলর নিয়োগ দেওয়া আবশ্যক। মানসম্পন্ন টয়লেটেরও দাবি করেন তিনি।

অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া বলেন, কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করতে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের ব্যবস্থাপক কণিকা ফেরদৌস বলেন, শহরের কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশ বস্তিতে থাকে। তারা অনেকে অসংগঠিত খাতে কাজে ব্যস্ত থাকে। তাদের ঝুঁকি বেশি। যারা স্কুলে যায়, তাদের একটি অংশ মাসিকের সময় তিন-চার দিন স্কুলে আসা বন্ধ রাখে। তিনি স্কুলে কম মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহের কথা বলেন।

কিশোর–কিশোরীদের প্রজনন–স্বাস্থ্য নিয়ে নেদারল্যান্ডস সরকার বাংলাদেশে কী করছে, তার বর্ণনা দেন দেশটির দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ নীতি পরামর্শক মাশফিকা জামান সাটিয়ার। তিনি জানান, ব্যবহারের পর সহজে পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁরা কাজ করছেন। তিনি বলেন, প্রজনন–স্বাস্থ্য বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে যেটুকু আছে, তাও শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয় না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউবিআরের কর্মসূচি সমন্বয়কারী শার্মিন ফরহাত ওবায়েদ বলেন, কিশোর-কিশোরদের জন্য কৌশলপত্র তৈরি হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি আছে। তারপরও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকেরা পড়াতে সংকোচ বোধ করেন।

ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বলেন, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন–স্বাস্থ্যের উদ্যোগগুলো বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। শহরের ৪০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী স্কুলে গেলেও ৩০ শতাংশ স্কুলেও নেই, কাজেও নেই। তিনি বলেন, কিশোর-কিশোরীদের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলাও জরুরি।

সরকারি বেসরকারি উদ্যোগের কারণে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আছে উল্লেখ করে গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য পরামর্শক মোমেনা খাতুন বলেন, জনসচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম, নীতি পরামর্শে ইউএনএফপিএ এবং সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণে দাতারা ভূমিকা রাখতে পারে।