আসন ভাগাভাগিতে ঐক্যফ্রন্টে মতানৈক্য

প্রথম অালো ফাইল ছবি
প্রথম অালো ফাইল ছবি

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সাত দফা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই দলগুলোর শক্ত ঐক্য রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনার জন্ম দেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্যে একটি ভারসাম্য আনবে, এমন প্রত্যাশা ছিল আওয়ামী লীগের বিরোধীদের মধ্যে। গত ১৩ অক্টোবর গঠন হওয়া ঐক্যফ্রন্ট এত দিন রাজনীতির মাঠে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করলেও নির্বাচনের আসন ভাগাভাগির সময়ে এসে এই রাজনৈতিক দলের ঐক্য ততটা অটুট দেখা যাচ্ছে না। আসন ভাগাভাগি ছাড়াই ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছে।

এমনকি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যকে ৯টি আসন দেওয়া হলেও ওই সব আসনে বিএনপির অনেক নেতাকেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ধানের শীষের প্রার্থী কারা, সেটা জানা যাবে প্রতীক বরাদ্দের চিঠি দেওয়ার সময়। অর্থাৎ আগামী ৯ ডিসেম্বর বা এর কাছাকাছি সময়ই মূলত প্রার্থী চূড়ান্ত করবে ঐক্যফ্রন্ট। অবশ্য ইতিমধ্যে এই জোটের সব দলই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন কাল বুধবার। বিএনপি নিজ দলের প্রার্থীদের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু শরিকদের আসনের প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি। নাগরিক ঐক্য নয়টি আসন পাওয়ার কথা জানালেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক অন্য দলগুলো বলছে, এখনো পরিষ্কারভাবে কিছু জানানো হয়নি। দলগুলো আপাতত নিজেদের মতো করে দলীয় প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে আসন বণ্টন ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, আসন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। রাজনীতিতে ভাগাভাগি একটি জটিল বিষয়। এ নিয়ে দর-কষাকষি সারা দুনিয়াতেই হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা কোনো সমস্যা হয় না। কারণ সবাই চায় নির্বাচন সুষ্ঠু হোক এবং জেতার প্রত্যাশা করে। সেখানে জেতার মতো কোনো প্রার্থী থাকলে যে কেউই একমত হবে। পরিচিতিই নাই, এমন কোনো প্রার্থীকে কেউ দিতে চাইবে না। প্রার্থী যে দলেরই হোক, তাঁকে জেতার মতো প্রার্থী হতে হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল দুজন নেতা বলেছেন, ২৪০ আসন নিজেদের জন্য রাখছে বিএনপি। বাকি ৬০টি আসন ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। তবে এতে ঐক্যফ্রন্টের চেয়ে ২০ দল বেশি আসন পাবে। দুই জোট মিলিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। এর মধ্যে আবার নতুন নতুন নেতা যোগ দিচ্ছেন বিএনপি, গণফোরামসহ কয়েকটি শরিক দলে। নতুনদের মধ্যেও মনোনয়ন পাওয়ার মতো কয়েকজন প্রার্থী আছেন। যদিও গতকাল মির্জা ফখরুল বলেছেন, সংখ্যার বিষয় এখনো নির্ধারিত হয়নি। এ ছাড়া বিএনপি এবার মনোনয়ন প্রত্যাহারের অঙ্গীকারপত্রও রেখে দিচ্ছে।

বিএনপি ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের চার শরিক গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য, জাসদের (জেএসডি) বড় প্রত্যাশার বিপরীতে বিএনপির কম আসনে ছাড় দেওয়ার মানসিকতার কারণেই এখনো পর্যন্ত এই জোট আসন ভাগাভাগি নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি।

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে নির্বাচন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ও নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নানা ইস্যুতে অভিযোগসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি দলের সঙ্গে সংলাপসহ নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও হয়েছে তাদের। তবে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দলগুলোর নেতারা তেমন কোনো আলোচনাই করেনি। যেটুকু আলোচনা হয়েছে তাতে কোনো সমাধানে আসেনি।

বিএনপি বিভিন্ন আসনে একাধিক প্রার্থী দিচ্ছে। আসন ভাগাভাগিতে বিএনপি ‘উদার’ থাকবে বলে শুরুতে বলা হলেও এখন তারা আসন ছাড়ার ব্যাপারে বেশ ভাবছে। আবার ঐক্যফ্রন্টের শরিকেরা ভোটের মাঠে নিজেদের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি আসন চাচ্ছে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদের একটি ‘ফোনালাপ’ ফাঁসের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে আসন নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিকেরা ‘ব্ল্যাকমেল করছে’ এমন অভিযোগ করা হয়।

সে অভিযোগের বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে জানতে চাইলে গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এসব ভাষা ব্যবহার না করে ভদ্রভাবে কথা বলা উচিত। অন্যদিকে শরিকদের কথা, তারা জোটের সঙ্গে এত দূর এসেছে, আসনের ক্ষেত্রে কিছুটা ভারসাম্য চায়।

গতকাল কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, আসন ভাগাভাগিতে ‘কাড়াকাড়ি’ হবেই। আসন ভাগাভাগি চ্যালেঞ্জের কাজ।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করা ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টের বড় শরিক বিএনপি এবার ‘যোগ্য’ প্রার্থীদেরই চায় বলে জানান দলের নেতারা।

আজ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ড. কামাল হোসেন বলেন, সময়ের স্বল্পতার কারণে তাঁরা এখন দলীয়ভাবে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। পরে সমন্বয় করে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগেই আসন বণ্টন হবে। অন্যদিকে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানান মির্জা ফখরুল।

আসন ভাগাভাগির ব্যাপারে জেএসডির শীর্ষ একজন নেতা কিছুটা হতাশার সুরেই বললেন, সব বিচ্ছিন্নভাবে হচ্ছে। তাঁদের নিজেদের মতো মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলেছে বিএনপি। তাই কোনো কিছু নিশ্চিত না হওয়াতে দলের লোকও খুব বেশি মনোনয়নপত্র দাখিল করতে আগ্রহী হবেন না।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, এখনো কিছু ঠিক হয়নি। এখন দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আসনগুলোর সমঝোতা হয়ে যাবে। 

বিএনপি দুদিন ধরে নিজেদের প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত। ঐক্যফ্রন্টের সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে কোনো বৈঠক সম্প্রতি হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে নিজেদের মতো করে এক দল অন্য দলের সঙ্গে কথা বলেছে। আজ বিভিন্ন দলের নেতাদের কথায় কিছুটা টানাপোড়েনের সুর টের পাওয়া গেল। শরিকদের দলের প্রার্থী ও শীর্ষ নেতাদের অনেকেই এখন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় চলে গেছেন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য।

বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব চূড়ান্ত হবে বলে মহাসচিব বলেছেন। এ ছাড়া গত রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে মূল লক্ষ্য রেখে সিদ্ধান্ত নিতে।