নারীর অধিকারের প্রতিশ্রুতি দাবি

‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক ইশতেহার: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক ইশতেহার: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে শূন্য সহনশীলতার প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন নারী অধিকারকর্মীরা। গতকাল প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে তাঁরা এই দাবি তোলেন। গোলটেবিল আয়োজনে সহায়তা করে অ্যাকশনএইড। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক ইশতেহার: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা’ শিরোনামে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো কার্যালয়ে। অনুষ্ঠানে অ্যাকশনএইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবীর বলেন, নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলো গেল বেশ কয়েকটি নির্বাচনে নারী অধিকারের কথা বলেছে। আদতে বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতিই ছিল কথার কথা। প্রায় সব সময় নারী নির্যাতনের পর অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী কোনো নেতার ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নেন। তাই নেতাদের নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবে শূন্য সহনশীল হতে হবে।

 বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন। তিনি বলেন, জনগণের ভোটে যদি জেন্ডার সংবেদনশীল প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসেন, তাহলে ভালো ফল আশা করা যায়। উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন সাপোর্ট সেন্টারের অতিরিক্ত উপকমিশনার নুসরাত জাহান মুক্তা বলেন, পুলিশের কাজে মাঝেমধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানবাধিকার–বিষয়ক চিফ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার শর্মিলা রাসুল বলেন, ভোটারদের জানতে হবে তাঁরা কাকে নির্বাচিত করে আনছেন এবং সেই ব্যক্তি তাঁদের দাবির প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল।

 নিজেরা করির নির্বাহী পরিচালক খুশী কবির বলেন, নারী প্রার্থী হলেই তিনি নারীবান্ধব হবেন, বিষয়টি তেমন না–ও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদির স্ত্রীর মনোনয়ন পাওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন।

জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরামের চেয়ার মমতাজ আরা রুমি বলেন, নির্বাচন কালোটাকা ও পেশিশক্তিমুক্ত হওয়া দরকার।

নারীপক্ষের সদস্য শিরীন পারভীন হক মনে করেন, গণতন্ত্র সবকিছুর খুঁটি। ডাকসু নির্বাচন বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে না। নারীদের প্রতি সহিংসতারোধে রাজনৈতিক ইশতেহার বাস্তবায়নে আগে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রয়োজন।

নারী নির্যাতনকারীকে নির্বাচনে প্রার্থী না করার দাবি
নারী নির্যাতন করেছেন এমন কাউকে নির্বাচনে প্রার্থী না করার দাবি করেছেন নারী অধিকারকর্মীরা। এ ধরনের অভিযোগ যেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, তাঁদের একটি তালিকা তৈরির কথাও ভাবছেন তাঁরা। গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন আলোচকেরা।

 ‘নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে রাজনৈতিক ইশতেহার: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, নৈতিক স্খলনের দায়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা হারান প্রার্থীরা। সে ক্ষেত্রে প্রার্থীর আচরণ নারীবিদ্বেষী কি না, তিনি বহুবিবাহ বা বাল্যবিবাহ করেছেন কি না—এ বিষয়গুলো খুঁজে দেখা যায় এবং তাঁকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখা যায়। সংবাদমাধ্যমগুলো প্রার্থীরা কেমন, সে সম্পর্কে জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠান সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সেগুলোও নারীবিদ্বেষী প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে পারে। যদি এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো এ ধরনের প্রচারকে রাজনৈতিক প্রচার বলে আখ্যা দেয় তাহলে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

 যাঁদের বিরুদ্ধে নারীর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ আছে, তাঁদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করে জনসমক্ষে প্রচার করার কথা বলেন নিজেরা করির নির্বাহী পরিচালক খুশী কবির। তাঁর মতে, জনচাপ ও জনজবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাইয়ে সতর্ক হবে।

 অ্যাকশনএইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবীর বলেন, জনপ্রতিনিধিদের জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে। কারণ, নির্বাচনের পঞ্চাশ ভাগ ভোটার নারী। তিনি আরও বলেন, জেন্ডার সংবেদনশীল প্রার্থী বাছাইয়ে ভোটারদের ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের নিশ্চিত হতে হবে তাঁরা কোনো নির্যাতক, নিপীড়ক বা নির্যাতনের প্রশ্রয়দানকারী ব্যক্তিকে ভোট দিচ্ছেন না।

জেন্ডার সংবেদনশীল প্রার্থী যদি না হন তাহলে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা যাবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে দুর্নীতিতে তারা জিরো টলারেন্ট। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে নয় কেন? যখন কন্যাশিশুটি নির্যাতনের শিকার হয়, তখন উন্নয়নের চকচকে চেহারা আর থাকে না।

 এখনো পর্যন্ত কোনো নারী বা শিশু নির্যাতনের শিকার হলে প্রথমেই জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে দেখা যায় না বলে মন্তব্য করেন অ্যাকশনএইডের ব্যবস্থাপক (উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি) কাশফিয়া ফিরোজ।

পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার নুসরাত জাহান পুলিশের নারী ও শিশুসহায়তা কেন্দ্র থেকে কী কী সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে, সে সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, নির্যাতনের শিকার নারী, হোক তিনি একজন স্নাতক কিংবা নিরক্ষর নারী—দুই স্তরের মানুষই গোপনীয়তা চান। তারপরও আশার কথা, নারীরা এখন অভিযোগ করছেন আগের চেয়ে বেশি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর সহিংসতা রোধে বেশ কিছু আইন হয়েছে। তিনি আশাবাদী, সামনে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

অনুষ্ঠানে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে নারীর প্রতি তারা যে অঙ্গীকার করেছিল, সেটা কেন বাস্তবায়ন করল না, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। সংবাদমাধ্যমের উচিত কাজগুলো নজরদারির পাশাপাশি মূল্যায়ন করা।

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) জেন্ডার অ্যান্ড ডাইভারসিটি স্পেশালিস্ট ফারজানা শাহনাজ মজিদ বলেছেন, নারীরা হয়রানির শিকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় অভিযোগ জানাবেন, সে সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসতে হবে ইশতেহারে।