খাসিয়াপুঞ্জির বর্ষবরণে

উৎসবের সাজে খাসিয়া তরুণীরা
উৎসবের সাজে খাসিয়া তরুণীরা

শ্রীমঙ্গলের মাগুরছড়া খাসিয়াপু​ঞ্জিতে ঢোকার মুখেই টিলার ঠিক নিচে একটা বড় পুকুর। পুকুরে মহা উৎসাহে মাছ ধরা হচ্ছে। পুকুর ঘিরে খাসিয়া তরুণ যুবক, কেউ জাল ফেলে কেউ বড়শি পেতে গভীর মনোনিবেশে পানির দিকে চেয়ে আছে। চারপাশে বিরাট হই–হলা। পুকুরটা ডানে রেখে টিলার পাশ দিয়ে খানিক পথ হাঁটলে বড় এক মাঠ। মাঠ নয়, উপত্যকা বলাই ভালো। কেননা, চারপাশে ছোট ছোট টিলা যেখানে খাসিয়াদের পুঞ্জি বা গ্রাম, মধ্যে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা। গোটা মাঠটাকে বর্ণিল কাগজে সাজানো হয়েছে। একদিকে একটা ছোট মঞ্চ, সামনে কয়েকটা চেয়ার আর অপর পাশে মাঠ ঘিরে নানা রকমের স্টল। স্টলে স্থানীয় খাসিয়ারা নিজেদের তৈরি গুলতি, কাপড়, খাবারদাবার, ঝুড়ি ইত্যাদির পসরা নিয়ে বসেছেন। নানা বয়সী খাসিয়ারা চারপাশে বি​ক্ষিপ্ত হাঁটাহাঁটি করছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ গল্পে মজে উঠেছে। আজ (২৩ নভেম্বর) তাদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসব-খাসি সিং কুটস্নেম।

খাসিয়াপুঞ্জির অন্যতম উৎসব এই বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ। ইদানীং সিলেট অঞ্চলে বসবাসরত খাসিয়াদের প্রায় ৮০ শতাংশই খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত। তাই বড়দিন ও ইস্টার সানডে পালিত হয় জোরেশোরে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী কিছু পার্বণ–উৎসবও পালন করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হলো খাসি সিং কুটস্নেম। এই দিনটি খাসিয়া সম্প্রদায়ের জন্য খুবই আনন্দের। অনুষ্ঠান দেখতে বাইরে থেকেও আসেন অনেক অতিথি ও পর্যটক।

মাগুরছড়াপুঞ্জির মন্ত্রী বা হেডম্যান ফিলা পথমীর সঙ্গে পরিচয় হলো। সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে এ রকম প্রায় ৭০টির মতো খাসিয়া গ্রাম বা পুঞ্জি রয়েছে। একেকটি পুঞ্জিতে গড়ে ৫০টির মতো খাসিয়া পরিবার বাস করে। বংশপরম্পরায় মন্ত্রী হলেন সেই পুঞ্জিপ্রধান। আজ থেকে প্রায় পাঁচ–ছয় শ বছর আগে আসাম ও মেঘালয় রাজ্য থেকে খাসিয়াদের আগমন ঘটে এ দেশে। খাসিয়া জৈ​ন্তা পাহাড়ের পাদদেশে নানা এলাকায় বসত গড়ে তোলে। বর্তমানে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার অরণ্যঘেরা টিলায় বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে তারা। অনেক আগে খাসিয়ারা ছিল যাযাবর। বর্তমানে তাদের প্রধান পেশা পান চাষ। টিলার চারদিকে বড় বড় গাছ বেয়ে লতার মতো পানগাছ উঠে গেছে অনেক ওপরে। খাসিয়া তরুণেরা অনায়াসে উঁচু গাছের মগডালে উঠে সেই পান পেড়ে আনতে পারে। এ কাজে তারা যে কত দক্ষ, তা একটু পরই প্রমাণিত হবে।

তো ফিলা পথমীকে জিজ্ঞেস করলাম, মঞ্চের পেছনে ব্যানারে উৎসবের নাম ইংরেজিতে লেখা কেন? তিনি জানালেন, কোনো একসময় হয়তো খাসি ভাষার বর্ণমালা ছিল কিন্তু এখন তা হারিয়ে গেছে। এখন তাঁদের মুখের ভাষা খাসি কিন্তু তা লেখা হয় রোমান হরফে। ১৮৩৮ সাল থেকে রোমান হরফে খাসি ভাষা লিপিবদ্ধ হতে থাকে। ওয়েলস ক্যালভিনিস্টিক মিশনারি দলের টমাস জোনস প্রথম রোমান হরফে খাসি ভাষা লেখা শুরু করেন।

দুপুর নাগাদ খেলা শুরু হলো। প্রথমে গুলতি মারা প্রতিযোগিতা। তারপর তির–ধনুক। তরুণ যুবকেরাই এই প্রতিযোগিতার খেলোয়াড়। লক্ষ্যবস্তুতে ঠিকঠাক তির বিঁধাতে পারলেই উল্লাসে ফেটে পড়ছে সবাই। অনেকক্ষণ ধরে মাঠের মধ্যে একটা পানভর্তি বেতের ঝুড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। ওটা দিয়ে কী হবে, বুঝলাম একটু পর। এই খেলাটি মূলত মেয়েদের। খেলার নাম পানপুঞ্জি। একজন বয়স্ক লোক ঝুড়ির সব পান উল্টে দিলেন পাটির ওপর। পাটি ঘিরে বসেছে কয়েকজন কিশোরী তরুণী। খেলা শুরু হলো। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মেয়েরা পানগুলো সমান সংখ্যায় ও সমান আকারে পুঁটলি বাঁধতে লাগল। চারদিকে সবাই চেঁচিয়ে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। কে কত বেশি বাঁধতে পারে! তারপর একসময় বাঁশি বেজে উঠল। সময় শেষ। বিজয়ী ঘোষণা করা হলো যে সবচেয়ে বেশি পুঁটলি বাঁধতে পেরেছে তাকে। তারপরের খেলাটা আরও চমকপ্রদ। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠা। আগেই বলেছি, খাসিয়া কিশোর–তরুণেরা বাঁশ বা গাছ বেয়ে উঠতে ওস্তাদ। দারুণ দক্ষতার সঙ্গে একেকজন মুহূর্তের মধ্যে বাঁশ বেয়ে উঠে যাচ্ছে একেবারে উঁচুতে। তারপর হাততালি। এবার একটু বিরতি। দুপুর গড়িয়ে আসছে। যে যার মতো খাবার নিয়ে এসে খেতে বসেছে। আমরা কলাপাতায় মোড়ানো জাদো নিয়ে এলাম। জাদো হলো খিচুড়ি, ভর্তা, ডিম, মুরগি বা শূকরের মাংস ছেঁচে পেঁয়াজ–মরিচ দিয়ে মেখে সব একসঙ্গে পরিবেশন করা একধরনের খাবার। খেতে মন্দ নয়। খাওয়াদাওয়ার পর মূল আকর্ষণ নাচ–গান। ততক্ষণে পুঞ্জির ভেতর থেকে একে একে এসে হাজির হয়েছে চমৎকার সব পোশাক পরা তরুণ–তরুণী। সবাই তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত। শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রণনৃত্যসহ আরও কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করল তারা। সবই মনোমুগ্ধকর। নতুন বছরকে এভাবেই স্বাগত জানিয়ে শেষ হলো খানি সিং কুটস্নেম। চমৎকার এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে কারও কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রতিবছর নভেম্বরের শেষে পালিত হয় এই অনুষ্ঠান। যে কেউ উপভোগ করতে পারেন। অন্যান্য পুঞ্জিরও আছে নানা ধরনের উৎসব। এখানেই পরিচয় হলো কুলাউড়াপুঞ্জির মন্ত্রী মনিকা খংলার সঙ্গে। তিনি তাঁর পুঞ্জিতে বসন্তকালে কুমার–কুমারীদের উৎসব ‘সাত সুক মেনসিং’ দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিম আকাশে। খাসিয়াদের বর্ষবরণ শেষ। আমাদেরও বিদায় নেওয়ার পালা। খুবলাই বা ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা। চমৎকার একটি দিনের স্মৃতি রইল সঞ্চিত হয়ে।