সাবলু-ডিউক থাকলেও আলোচনার কেন্দ্রে জিয়াউদ্দিন বাবলু

জিয়াউদ্দিন বাবলু। ফাইল ছবি
জিয়াউদ্দিন বাবলু। ফাইল ছবি

রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে নির্বাচনী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন জিয়াউদ্দিন বাবলুর নাম। তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত প্রার্থী। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব। বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য।

বাবলু ছাড়াও ওই আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন বদরগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি আসাদুজ্জামান চৌধুরী সাবলু। এই আসনে জাতীয় পার্টির শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। অতীতের নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী ওই আসনে বিএনপির অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এখানে বিএনপির মোহাম্মদ আলী সরকার ও মাহফুজ উন নবী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

এলাকায় হঠাৎ জিয়াউদ্দিন বাবলুর নাম আলোচনায় আসে জাপা থেকে তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর। আওয়ামী লীগের দলীয় সাংসদ আবুল কালাম মো. আহসানুল হকেরও (ডিউক চৌধুরী) এখন মাথাব্যথা বাবলুকে নিয়ে। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় বাবলুকে মহাজোটের প্রার্থী করা হলে ডিউক চৌধুরীকে দলের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হতে পারে।

স্থানীয় জাপা সূত্রে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তার ও নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে জাতীয় পার্টি এখানে তিন ধারায় বিভক্ত। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছেন জাতীয় পার্টির রংপুর জেলা কমিটির সদস্য সাবেক সাংসদ আনিছুল ইসলাম মন্ডল, অন্য ধারায় আসাদুজ্জামান চৌধুরী সাবলু এবং বাকি ধারায় জাতীয় আইনজীবী ফোরামের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোকাম্মেল হক চৌধুরী।

জাতীয় পার্টির নেতা–কর্মীদের একটি অংশ বলেছে, আনিছুল ইসলাম মন্ডলের নেতৃত্বাধীন ধারাটি শক্তিশালী। আনিছুল ইসলাম দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন দেওয়ায় অন্য দুই ধারার জাপার নেতা–কর্মীরা দলীয় চেয়ারম্যান এরশাদের প্রতি নাখোশ হয়েছেন।

জাপার নেতা–কর্মীদের অভিযোগ, আসাদুজ্জামান চৌধুরী বদরগঞ্জ উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে জাপায় যোগ দিয়ে জাপার সাংসদ আনিছুল ইসলাম মন্ডলকে টপকিয়ে বদরগঞ্জ উপজেলার জাপার সভাপতির পদ পেয়ে যান এবং সংসদ নির্বাচনে নতুন দলের প্রার্থী হিসেবে ওই আসনে মনোনয়ন পান। পরে এরশাদের নির্দেশে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। তখন বিনা ভোটে সাংসদ নির্বাচিত হন বদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম মো. আহসানুল হক ওরফে ডিউক চৌধুরী।

জিয়াউদ্দিন বাবলু জাপার কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় এলাকায় জাপার নেতা, কর্মী ও সমর্থক ভোটারদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। তাঁর পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ধরনের আলোচনাই চলছে। আসাদুজ্জামান চৌধুরীর বিরোধী জাপার দুটি ধারা মন্দের ভালো হিসেবে বহিরাগত হলেও জিয়াউদ্দিন বাবলুকেই দলীয় প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিচ্ছেন। মোকাম্মেল হক চৌধুরীর ধারাটি প্রকাশ্যেই অবস্থান নিয়েছেন বাবলুর পক্ষে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় আপাতত মুখ খুলছেন না আরেক ধারার নেতা আনিছুল ইসলাম মন্ডল। তবে তাঁর অনুসারীরাও বাবলুকে এখন সমর্থন দিচ্ছেন। আসাদুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ধারাটি বাবলু হটাও আন্দোলনে নেমেছে।

বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগও তিন ধারায় বিভক্ত। একধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাংসদ ডিউক চৌধুরী, অপর ধারায় বদরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আহসানুল হক (টুটুল চৌধুরী)। ডিউক ও টুটুল চাচাতো ভাই। আরেক ধারার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ বিশ্বনাথ সরকার বিটু। টুটুল চৌধুরীর সঙ্গে আছেন বদরগঞ্জ পৌরসভার টানা চারবারের নির্বাচিত মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি উত্তম কুমার সাহা ও বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ নেতা ফজলে রাব্বী সুইট।

টুটুল চৌধুরী, উত্তম কুমার সাহা ও বিশ্বনাথ সরকার দলীয় মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পাশাপাশি তাঁরা ডিউক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও স্থানীয় জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছেন এবং চেষ্টা করেছেন ডিউক চৌধুরী যেন মনোনয়ন না পান। তবু ডিউক চৌধুরীই মনোনয়ন পেয়েছেন। এতে অন্য দুই ধারার নেতা–কর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ কাজ করছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও বাবলুকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু করেছেন। তাঁদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত বাবলুই মহাজোটের প্রার্থী হবেন।

জিয়াউদ্দিন বাবলু প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে ওই আসনের আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অসংখ্য নেতা–কর্মী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা আমাকেই ওই আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান। এতে আমি অভিভূত হয়েছি।’

কেন্দ্রের নির্দেশনার বাইরে গেলে দল থেকে বহিষ্কার হতে পারেন—এমন আশঙ্কায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই ধারার নেতা–কর্মীরা আপাতত মুখ খুলছেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, ডিউক চৌধুরীকে মহাজোটের প্রার্থী করা হলে তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা ডিউকের পক্ষে মাঠে কাজ করবেন না।

জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, চট্টগ্রামের একটি আসনে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাজোটের প্রার্থী করার কথা ছিল। কিন্তু আসনটি জাপাকে ছাড়তে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, রংপুর-২ আসনটি ছাড়তে চাননি জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। তাই বাবলুকে স্থান করে দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ইঙ্গিতে এই আসনে বাবলুকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বলেন এরশাদ। এতে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ দুই দলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কিছুটা দূর হবে, বাবলুকে জিতিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং এরশাদ সন্তুষ্ট থাকবেন।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে ওই আসনে মহাজোটের হয়ে জাপার প্রার্থী আনিছুল ইসলাম মন্ডল দেড় লাখের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি এ টি এম আজহারুল ইসলাম। তিনি ভোট পেয়েছিলেন প্রায় ৩৬ হাজার।

বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি এলাকার ভোটার ইদ্রিস আলী (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাহে, শুনচি জাতীয় পাটিত আর আওয়ামী লীগোত নেজেরা নেজেরা কামড়াকামড়ি শুরু করি দেচে। তাহইলে ওরা ভোটোত টিকপে কেমন করি? ফাঁকোতে জাতীয় পাটিত বাবলু ঢুকি গেইচে। ভোট দেউক না দেউক সবায় এ্যালা বাবলুর নাও (নাম) কওচে। কিন্তুক হামরা তাক কোনো দিন দেকি নাই।’

তারাগঞ্জের ইকরচালির তরুণ ভোটার শওকত হোসেন (২৫) বলেন, বাবলুর নাম ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই এলাকায় আলোচিত হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত ও অগাধ অর্থসম্পদের মালিক জনগণের গম–চাল মেরে খান না। তিনি আরও বলেন, ‘দেখি, শেষ পর্যন্ত ভোটের ময়দানে কারা প্রার্থী থাকেন। ইতিপূর্বে দুর্নীতি করেছেন কিংবা ভবিষ্যতে দুর্নীতি করতে পারেন—এমন প্রার্থী যে দলেরই হোক, তাঁকে ভোট দেব না।’