আজও আদালতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সইয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত

আঞ্চলিক পরিষদ আইন পুরোপুরি বাতিলসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কয়েকটি ধারা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় আট বছর ধরে আপিল বিভাগে শুনানির জন্য পড়ে আছে। আইনি জটিলতার কারণে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে না। ২১ বছর ধরেই অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠান দুটি।

চাকমা সার্কেলপ্রধান দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘আইনি জটিলতা চুক্তির সফল বাস্তবায়নকেও জটিল করে তুলেছে। বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকারের কোনো সদিচ্ছা দেখছি না।’ তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। এর ফলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলা সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান হয়।

তবে তখনকার বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সেটেলার বা পুনর্বাসিত বাঙালিদের সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে মোট ৭২টি ধারা ছিল। এর মধ্যে ৩৬টি ধারা জেলা পরিষদসংক্রান্ত। চুক্তিতে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে তিনটি জেলা পরিষদের বিধান রাখা রাখা হয়। এ জন্য চুক্তি হওয়ার পর ১৯৯৮ সালে সরকার আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিনটি জেলা পরিষদের জন্য তিনটি পৃথক আইন করে।

২০০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন বাতিলসহ ‘জেলা পরিষদ সংশোধনী আইন ১৯৯৮’–এর কয়েকটি ধারা বাতিলের জন্য রাঙামাটির কাউখালীর বাসিন্দা বদিউজ্জামান হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। অন্যদিকে, ২০০৭ সালে চুক্তি কেন বাতিল হবে না—এই মর্মে রিট দায়ের করেন আইনজীবী তাজুল ইসলাম।

২০১০ সালের এপ্রিল মাসে রিট দুটির বিষয়ে রায় দেন হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমেদ এবং মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠন করা বেঞ্চ।

রায়ে পার্বত্য চুক্তি বাতিলের আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। তবে আঞ্চলিক পরিষদকে ‘বাংলাদেশের একক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়’ বলে আঞ্চলিক পরিষদ আইন বাতিল করে দেন। চুক্তিতে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনে উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য সার্কেলপ্রধানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। আদালত এই ধারার অ-উপজাতীয় অংশকে সংবিধানের ২৭, ২৮ (১), ২৯ (১) এবং ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা বাতিল করে দেন। আইনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও পুলিশে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় উপজাতিদের প্রাধান্য দেওয়ার যে ধারা চুক্তিতে ছিল, তাও বাতিল করেন আদালত।

হাইকোর্টের এ রায়ের পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করা হয়। চেম্বার জজের আদালত রায় স্থগিত করেন। ২০১১ সালের ১৩ মার্চ এ রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করার জন্য অনুমতি দেন আপিল বিভাগ। ছয় বছর পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার আংশিক শুনানি হয়। এ বছরের ৯ জানুয়ারি শুনানি গ্রহণের জন্য মামলাটিকে প্রাধান্যের তালিকায় রাখা হয়। তবে শুনানি হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের আইনি পরামর্শক জুয়েল দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কেন জানি এই ইস্যুতে অনীহা কাজ করে। এর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারের আইন কর্মকর্তাদের তৎপর হতে দেখা যায়। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির এই বিষয় নিয়ে অজ্ঞাত কারণে তারা গড়িমসি করে।’ তিনি অভিযোগ করেন, সরকারের অনীহার পাশাপাশি রিটকারীপক্ষও দিনের পর দিন সময় চেয়ে মামলাটি দীর্ঘায়িত করছে।

রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে এমন সময় ব্যয় মোটেও অনাকাঙ্ক্ষিত নয়।

হাইকোর্ট বিভাগে ২০১০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিলের আবেদন খারিজ হওয়ার পর আবেদনকারী তাজুল ইসলাম আপিল বিভাগে আবেদন করেন চলতি বছরের এপ্রিল মাসে। এত দিন পর আবেদন কেন—জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট একাধিক মামলার রায়ে আমাদের আপিলের স্পিরিটের বিপরীতে কিছু কথা বলেছিলেন। ওই অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভেবেছিলাম, একটি আপিল করে রাখা ভালো।’

আঞ্চলিক পরিষদ এবং পাহাড়ের নেতৃস্থানীয়রা বলছেন, চুক্তি নিয়ে আদালতের রায়ের একটা সুরাহা হওয়া উচিত । রায় পক্ষে এলে চুক্তির আইনি ভিত্তি মজবুত হতো। আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও জেলা পরিষদ আইন বাস্তবায়ন হতে পারত, নির্বাচন হতে পারত। আর বিপক্ষে এলেও সরকার সংবিধানে সংশোধনী আনার মতো পদক্ষেপ নিতে পারত। কিন্তু এখন বিষয়গুলো ঝুলে আছে।

মামলাটি আপিল বিভাগে গড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং চাকমা সার্কেল প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় এর পক্ষভুক্ত হন। তিন জেলা পরিষদও পক্ষভুক্ত হয়।

দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘আইনি জটিলতার সুরাহায় পার্বত্য মন্ত্রণালয় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করেনি। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকেও কার্যকর তৎপরতা ছিল বলে মনে হয়নি।’

তবে দেবাশীষ রায়ের অভিযোগের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেছেন, ‘মন্ত্রণালয় নিয়মিত মামলার খোঁজখবর রেখেছে। এ অভিযোগ অযাচিত।’

চলমান মামলা নিয়ে নিজে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি বলে স্বীকার করেন প্রতিমন্ত্রী।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিটকারীপক্ষ, এমনকি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে বারবার সময় চাওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুবার প্রধান বিচারপতি পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর।’

আগামী জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে আপিল বিভাগের শুনানির জন্য দিন নির্ধারিত আছে বলে জানান মুরাদ রেজা। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন প্রস্তুত। আশা রাখি, এ নিয়ে আর বিলম্ব হবে না।’ কিন্তু এই কথায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না আঞ্চলিক পরিষদের ও পাহাড়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা।