কত দিন মা ডাক শুনি না

বাবার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে নিখোঁজ পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ শিরোনামের আলোচনা সভায়।  ছবি: হাসান রাজা
বাবার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলে নিখোঁজ পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ শিরোনামের আলোচনা সভায়। ছবি: হাসান রাজা

আয়েশা আলীর ছেলে আবদুল কাদের ভূঁইয়া রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে পাঁচ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন। একমাত্র সন্তানের খোঁজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে ধরনা দিয়েছেন মা। তবু কলেজপড়ুয়া ছেলের হদিস পাওয়া যায়নি। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার আয়োজিত আলোচনা সভায় এসে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি আয়েশা আলী।

কান্নাভেজা চোখে আয়েশা আলী বলেন, ‘একজন মায়ের কাছে সবচেয়ে বড় সুখ সন্তানের মুখে মা ডাক শোনা। গত পাঁচ বছর মা ডাক শুনতে পাই না। আমার একটাই সন্তান। এই সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। কেন বছরের পর বছর কষ্ট পেতে হচ্ছে? আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন।’

বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের ডাক’ শিরোনামে গতকাল আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় নিজেদের দুঃসহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা। স্বজন গুম হওয়ার পরের পরিস্থিতি, নিজেদের বদলে যাওয়া জীবনের কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদে প্রতিটি পরিবার। কারও মা, কারও বোন ঘটনার বর্ণনা দেন। তাঁরা প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। পাঁচ বছর ধরে পরিবারগুলো এমন সভার আয়োজন করে আসছে। গতকাল ৩০টির বেশি পরিবার সভায় উপস্থিত ছিল।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সাজেদুল ইসলামসহ আটজন ঢাকার শাহীনবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। গতকাল সভার শুরুতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান সাজেদুলের বড় বোন মারুফা ইসলাম। তাতে বলা হয়, নিখোঁজ সন্তানদের ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে জানাতে অনেক বাবা মারা গেছেন। মায়েরা কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হতে বসেছেন। স্বজনেরা আর কাঁদতে চায় না। তারা অপেক্ষার অবসান চায়।

পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের দাবি জানানো হয়। সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে ক্রসফায়ার, গুম বন্ধের সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতি আহ্বান জানান নিখোঁজদের স্বজনেরা।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাসা থেকে অস্ত্রধারীরা তুলে নেয় সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতি সেলিম রেজাকে। তাঁর বোন রেহানা বানু বলেন, ‘ভাইয়ের ছবিটি বুকে নিয়ে আছি। র‍্যাব, পুলিশ সবার কাছে গিয়েছি। আদালতে মামলা করেছি। মানবাধিকার কমিশনে গিয়েছি। আর কোথায় গেলে ভাইয়ের খোঁজ পাব, জানি না।’

সভায় মঞ্চের সামনে এক পাশে বসেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের মা ও বোনেরা। অন্য পাশে বাবা ও ভাইয়েরা। আর মঞ্চের বাঁ পাশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্তানেরা। সন্তানদের কেউ নবম শ্রেণি, কেউ চতুর্থ শ্রেণি, কেউ দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এই সন্তানদের সময় কাটে বাবার অপেক্ষায়।

বংশাল থেকে পাঁচ বছর আগে নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের মেয়ে আদিবা ইসলাম সভার শুরু থেকে মায়ের পাশে চুপ করে বসে ছিল। আদিবাকে কিছু বলতে অনুরোধ করা হয়। আদিবা বলে, ‘আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সঙ্গে স্কুলে যাব।’ এরপর কান্নার দমকে আর কিছু বলতে পারেনি আদিবা।

গত বছর ধানমন্ডি থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। তাঁর মেয়ে সামিহা জামান বলেন, ‘গত এক বছরে কোথায় যাইনি? পরিবারের পক্ষ থেকে সব চেষ্টা করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি। একজন ব্যক্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে?’

সভায় নিখোঁজদের পরিবারকে সহমর্মিতা জানাতে এসেছিলেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিচালক নাসিরুদ্দীন প্রমুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাওয়া না গেলে সমবেদনার মানে হয় না। সরকারবিরোধীরা বেশি গুম হয়েছে, তাই ভাবনার সুযোগ রয়েছে, এটি পরিকল্পিত। রাষ্ট্রের কাছে বিচার পাওয়া না গেলে স্বজনদের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।’

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই গুমের ঘটনাগুলো তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের দাবি জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, এসব গুমের ঘটনায় সরকার দায় এড়াতে পারে না। মানুষের আস্থা আছে, এমন তদন্ত কমিটি করে এসব গুমের ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সভায় সভাপতিত্ব করেন নিখোঁজ সাজেদুল ইসলামের মা হাজেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘কত দিন আর এভাবে আসতে হবে? আর আসতে চাই না। এভাবে আর পারছি না। আমাদের ছেলেদের ফিরিয়ে দিন।’