ভোক্তা অধিকার বেশ কার্যকর, অভিযোগে বৈচিত্র্য

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ছবি: প্রথম আলো
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর মিরপুর–১–এর বাসিন্দা নওশিন শবনম গত বছরের অক্টোবর মাসে একটি ট্রেডমিল কেনেন। স্টেডিয়াম মার্কেটের ফিলকো স্পোর্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ব্যায়ামের এই যন্ত্র কেনেন। কেনার তিন দিন পর দেখতে পান, যন্ত্রটি কিছুক্ষণ চালানোর পর অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। এই ত্রুটির ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগাযোগ করেন ট্রেডমিলটি পাল্টে নেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এতে কোনো সাড়া দেয়নি। তিনি টাকা ফেরত চাইলেও দেয়নি, এমনকি যন্ত্রটি ঠিক করে দেওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলে জানায় তারা। বেশ কিছু দিন ওই প্রতিষ্ঠানে ধরনা দেওয়ার পর কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ই–মেইলে অভিযোগ করেন।

নওশিন প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ জানানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর অধিদপ্তর থেকে তাঁদের দুই পক্ষকে শুনানিতে ডাকা হয়। শুনানিতে এসেই পাল্টে যায় ওই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে দুটো প্রস্তাব দেওয়া হয়—পুরো অর্থ ফেরত অথবা নতুন ট্রেডমিল। তারা নতুন ট্রেডমিল দিতে রাজি হয়। শুনানির তিন দিন পর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন আরেকটি ট্রেডমিল নিয়ে বাড়ি ফেরেন নওশিন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া যায় বলে অভিযোগের ধরনে এখন বৈচিত্র্য আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার ঘটনাগুলো প্রচার পায়, পণ্য কিনে ঠকে যাওয়া ক্রেতারা অভিযোগ করার মতো আস্থা পাচ্ছেন। এ কারণে আগের চেয়ে অভিযোগের ধরনেও নতুনত্ব এসেছে। এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানকে করা জরিমানার ২৫ শতাংশ পান অভিযোগকারী, এ বিষয়ও ক্রেতা-গ্রাহকদের অভিযোগ করার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে শুধু বোতলজাত পানি ও কোমল পানীয়র দাম বোতলের গায়ে লেখা মূল্যের চেয়ে বেশি রাখার অভিযোগ আসত বেশি। বছর দেড়েক ধরে অভিযোগের ধরনের বৈচিত্র্য এসেছে। মোবাইল ফোন প্রতিষ্ঠান, অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং, খাদ্যপণ্যসহ নানা পণ্যের ব্যাপারে অভিযোগ আসছে। তাঁর মতে, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি প্রচার হওয়ায় লোকজনের আস্থা এসেছে যে অভিযোগ করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। এ কারণে দিন দিন অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে।

দেশের একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে শাহীন আরা মমতাজ বলেন, ওই প্রতিষ্ঠানের বিস্কুটের মোড়কে বাদাম ও তিলভর্তি আকর্ষণীয় বিস্কুটের ছবি দেওয়া আছে। ছয় মাস আগে একজন ক্রেতা অভিযোগ করেন, মোড়ক খোলার পর বিস্কুটের সঙ্গে মোড়কের ছবির কোনো মিল পাননি, বাদাম প্রায় নেই বললেই চলে, বেশির ভাগ তিল বিস্কুট থেকে পড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা বাজার থেকে ওই বিস্কুটের প্যাকেট কিনে আনি। প্যাকেট খুলেই অভিযোগের সত্যতা পাই। খুবই নিম্নমানের বিস্কুট, বাদাম সামান্য আর মুচমুচেও না।’ তিনি আরও বলেন, আইনের ৪৪ ধারা ‘মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা’ অনুসারে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এই ধারায় ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বিস্কুটের বিজ্ঞাপনের জন্য জরিমানা করা হয়। শুনানিতে ওই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন তিনি। আইন অনুসারে অভিযোগকারীকে জরিমানার ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয় এবং বাকি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।

এ বছরের মার্চে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রকাশিত ইনফোগ্রাফ। ছবি: প্রথম আলো
এ বছরের মার্চে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে প্রকাশিত ইনফোগ্রাফ। ছবি: প্রথম আলো

শাহীন আরা মমতাজের কক্ষে বসে যখন কথা হচ্ছিল, তখন অন্য একটি অভিযোগের শুনানির জন্য সেখানে ঢোকেন এক ব্যক্তি। অভিযোগটি তাঁর খাবার দোকানের বিরুদ্ধে—বেশি দামে পানীয় বিক্রির জন্য। রাজধানীর লালবাগের শায়েস্তা খান রোডে ‘সুলতান কিচেন’ নামে একটি ছোট্ট খাবারের দোকান দুজন কর্মচারী দিয়ে চালান রেজাউল হক নামের ওই ব্যক্তি। অভিযোগ থেকে দেখা যায়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর অজয় কর্মকার নামের এক ব্যক্তি অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। ক্যাশমেমো ও বোতলের ছবি যুক্ত করে তিনি অভিযোগে জানান, সুলতান কিচেনে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি তিনি কোমল পানীয় মাউন্টেন ডিউয়ের ২৫০ মিলিলিটারের একটি বোতল নেন। বোতলের গায়ে দাম ১৮ টাকা লেখা থাকলেও তাঁর কাছ থেকে রাখা হয় ২০ টাকা।

তবে শুনানিতে সুলতান কিচেনের মালিক রেজাউল হক দাবি করেন, তিনি দোকানে কোনো বোতল রাখেন না। বড় বোতল থেকে কাপে ঢেলে পানীয় বিক্রি করেন, সে হিসাবে তিনি বোতলে দাম বেশি রাখার দায়ে দণ্ড পেতে পারেন না। অনেক ‘দুষ্ট’ ক্রেতা কর্মচারীদের অগোচরে বাইরে থেকে বোতল নিয়ে এসে দোকানে বসে খায় বলেও দাবি করেন তিনি। তবে শাহীন আরা মমতাজ ক্যাশমেমোতে কাপে দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় অভিযোগকারীর পক্ষে রায় দেন। তিনি দোকান মালিক রেজাউলকে শুরুতে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। তবে দোকান মালিক নিজেকে ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী’ দাবি করে কাকুতি-মিনতি করলে ‘ভবিষ্যতে এমন ভুল হবে না’—এমন মৌখিক প্রতিশ্রুতিতে শাহীন আরা মমতাজ জরিমানা কমিয়ে তিন হাজার টাকা করেন। রেজাউল তাৎক্ষণিকভাবে তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে বেরিয়ে যান।

সরকার ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করে। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর হয়। অভিযোগকারী ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ সম্পর্কে কোনো পণ্যের উৎপাদনকারী, প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী বা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে জরিমানা আরোপ করা হবে, তার ২৫ শতাংশ পাবেন অভিযোগকারী।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ সময়ে সবচেয়ে বেশি আসছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের (উবার, পাঠাও, ও ভাই ইত্যাদি) বিরুদ্ধে ভাড়া বেশি নেওয়াসহ প্যাকেজ অনিয়মের অভিযোগ। প্রায় প্রতিদিন বেশ কয়েকটি করে এই অভিযোগ আছে। এর আগে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে প্যাকেজের নামে প্রতারণা, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেবা না দেওয়া ও গ্রাহকের অজান্তে টাকা কেটে নেওয়ার অনেক বেশি অভিযোগ ছিল গ্রাহকদের। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গত বছরের শুরুতে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে অধিদপ্তর। প্রায় আটটি অভিযোগে তিনটি অপারেটরকে নয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আরও কয়েকটি অভিযোগ নিষ্পত্তির পর্যায়ে ছিল। এরই মধ্যে রবি জরিমানার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট আবেদন করে। এ ক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল, আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার কোনো বিধিমালা নেই এবং জুডিশিয়াল গাইডলাইন নেই। এগুলো হওয়ার আগে অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। রবির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ মে হাইকোর্ট কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে ভোক্তা অধিকার আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যক্রম আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। এরপর আর রিট আবেদনটির শুনানি হয়নি। এ মুহূর্তে অধিদপ্তরে এ–সংক্রান্ত ১ হাজার ৬০০–রও বেশি অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ঝুলে আছে।

জাতীয় ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে প্রতিবছর অভিযোগ পাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। সেই তালিকা অনুসারে অভিযোগ পাওয়া ও অভিযোগ নিষ্পত্তির তথ্য দেওয়া আছে। তবে কতটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। কারণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি মানেই আইন অনুসারে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা নয়। অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর তা প্রমাণিত না হলেও নিষ্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কতগুলো অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তা একত্র করা নেই। তাই তাঁরা বলতে পারছেন না। এমনকি পণ্য অনুসারে কোন ধরনের অভিযোগ কতটি এসেছে, সে সম্পর্কেও তথ্য আলাদা করা নেই বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

এদিকে তালিকা অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায় ১৭৯টি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৬৪টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬২টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছয় হাজার ১৪০টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯ হাজার ১৯টি এবং ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৪১৩টি। এর মধ্যে আগের অর্থবছরের সব কটিকে নিষ্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের ৩ হাজার ৪১৩টি অভিযোগের মধ্যে ১ হাজার ২৭৭টিকে নিষ্পত্তি দেখানো হয়েছে।

এ ছাড়া ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬৭২টি বাজার অভিযানে বিভিন্ন ধারায় ৮৯ হাজার ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৩৯ কোটি ১১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ২৫ শতাংশ হারে ৪ হাজার ২৪১ জন অভিযোগকারীকে জরিমানার ৭১ লাখ ২০ হাজার ৪২৭ টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ২ হাজার ১১০টি বাজার অভিযানে ৬ হাজার ৪৯৫টি প্রতিষ্ঠানকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, জরিমানা আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৪৮ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ টাকা এবং ৫৩৮ জন অভিযোগকারী পেয়েছেন ৯০ লাখ ১ হাজার ৬২৫ টাকা।

ভোক্তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, একটা সময়ে খুব কমসংখ্যক লোক ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এ–সংক্রান্ত আইন হওয়ার পর ক্যাব ও গণমাধ্যমের জনসচেতনতামূলক প্রচারে ভোক্তারা জানতে পেরেছেন, প্রতারিত হলে অভিযোগ করার জায়গা রয়েছে তাঁদের। অভিযোগ করলে প্রতিকার পাওয়া যায়। পাশাপাশি অভিযোগ প্রমাণিত হলে পুরস্কার হিসেবে জরিমানার ২৫ শতাংশ পাওয়া যায়। আগে বোতলজাত পানি ও কোমল পানীয়ের দাম বেশি রাখা নিয়েই অভিযোগ বেশি হতো। এখন বিক্রেতারাও সচেতন হয়েছেন। আর ক্রেতারাও জেনেছেন ইলেকট্রনিক পণ্য বা মুঠোফোনের প্যাকেজ বা অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের প্যাকেজ, ভাড়া নিয়েও এখন অভিযোগ জানানো যায়।

গোলাম রহমান বলেন, যত দিন যাবে, ভোক্তারা আরও সচেতন হবেন। একটা সময় আসবে যখন কোনো অভিযোগ থাকবে না। বিক্রেতাদের ভোক্তা ঠকানোর প্রবণতা কমে আসবে। তাঁরা বুঝতে পারবেন, ক্রেতা ঠকিয়ে লাভবান হওয়া যায় না। তিনি মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগের প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদালতের নির্দেশ অনুসারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।