আয় বেড়েছে, লোকসানি ব্যবসাও এখন লাভে

>

• ১০ মন্ত্রীর নির্বাচনী হলফনামা
• কারও আছে দোকানে বাকি, কারও স্ত্রীর গয়না অজানা
• আবার কারও স্ত্রীর আয় বেড়েছে বেশি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দেওয়া মন্ত্রিসভার আরও ১০ জন সদস্যের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদেরও আয় ও সম্পদ বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরা দিয়েছেন আগ্রহোদ্দীপক তথ্য। 
হলফনামা অনুযায়ী মন্ত্রীদের মধ্যে সম্পদে শীর্ষস্থানীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তাঁর লোকসানি ব্যবসা লাভে এসেছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু জানেন না, তাঁর স্ত্রীর গয়না কতটুকু, তার মূল্যই-বা কী। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ভাতার কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি হলফনামায়। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলী বাড়ি করার সময় মালামাল কিনে দোকানে বাকি রেখেছেন ২৬ লাখ টাকা।

ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক
ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক


ভাতার তথ্যই নেই প্রামাণিকের হলফনামায়
২০০৮ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিকের অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ টাকার। যা এখন বেড়ে ৬৫ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এবারের হলফনামায় দেখা যায়, কৃষি খাত থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে আয় আসে ১ লাখ ৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া আমেরিকাপ্রবাসী এক পুত্র, এক কন্যা ও জামাতার কাছ থেকে কিছু টাকা পান বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। তবে কোনো হলফনামাতেই মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে পাওয়া সম্মানীর কথা উল্লেখ করেননি। প্রামাণিকের হাতে নগদ ১০ লাখ টাকা, ব্যাংকে ৩৭ লাখ টাকা, সঞ্চয়পত্রে ও স্থায়ী আমানতে ১৫ লাখ টাকা এবং ৬ একর ৪২ শতক কৃষি ও ৭২ শতক অকৃষিজমি রয়েছে।

আনিসুল ইসলাম
আনিসুল ইসলাম


আনিসুল ইসলামের ২৬ কোটি
পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের অস্থাবর সম্পদমূল্য প্রায় ২৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা ২০০৮ সালে সাড়ে ১২ কোটি টাকার মতো ছিল। এখনকার সম্পদের মধ্যে বন্ড, ঋণপত্র, তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়-এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ আছে ১৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তাঁর স্ত্রীর আছে ১১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। 
আনিসুলের বার্ষিক আয় ১০ বছরের ব্যবধানে প্রায় ১২ গুণ বেড়েছে। এখন তাঁর আয় ৪ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল ৩৩ লাখ টাকা।

আ স ম ফিরোজ
আ স ম ফিরোজ


ফিরোজের আয়ের উৎস বেড়েছে
পটুয়াখালী-২ আসনের সাংসদ ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের আয়ের উৎস বেড়েছে। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তিনি শুধু বাড়িভাড়া বাবদ ২৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় দেখিয়েছিলেন। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে ব্যাংকে জমা টাকার সুদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সাংসদ হিসেবে ভাতা। ফলে তাঁর আয় বেড়ে প্রায় সাড়ে চার গুণ হয়েছে। সর্বশেষ ফিরোজের বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যার প্রায় ৯৭ লাখ টাকা আসছে ভাড়া থেকে। ফিরোজের ওপর নির্ভরশীলদের আয় সাড়ে ৬ লাখ টাকার মতো। 
মন্ত্রী পদমর্যাদা পাওয়া ফিরোজের নিজের অস্থাবর সম্পদ আছে ২ কোটি ১৭ লাখ টাকার, যা ১০ বছর আগে ২৮ লাখ টাকা ছিল। এখন তাঁর স্ত্রীর আছে ৬৩ লাখ ৮৩ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ।

মুজিবুল হক চুন্নু
মুজিবুল হক চুন্নু


স্ত্রীর গয়না কত, জানেন না মুজিবুল
স্ত্রীর গয়না কতটুকু এবং তার মূল্য কত, জানা নেই শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নুর। জাতীয় পার্টির এই নেতা এবারের হলফনামায় নিজের ও স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের বিস্তারিত তালিকা দিলেও সোনা ও মূল্যবান ধাতুর ঘরে নিজের ক্ষেত্রে লিখেছেন, মূল্য জানা নেই। স্ত্রীর ক্ষেত্রে লিখেছেন পরিমাণ ও মূল্য জানা নেই। গতবারও তিনি একই কথা লিখেছিলেন। 
এবারের হলফনামায় শ্রম প্রতিমন্ত্রী নিজের মোট আয় দেখিয়েছেন বার্ষিক প্রায় ৩৮ লাখ টাকা, যার বেশির ভাগ মন্ত্রী ও সাংসদ হিসেবে ভাতা। তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় প্রায় ১৮ লাখ টাকা, যা সিংহভাগ বেতন-ভাতা থেকে। দশম সংসদ নির্বাচনে মুজিবুল হক নিজের আয় দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, যার ৯৬ লাখ টাকা আসত ব্যবসা থেকে। 
মুজিবুল হকের নিজ নামে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে, যার বেশির ভাগ নগদ টাকা, ব্যাংকে জমা টাকা, কোম্পানির শেয়ার অথবা সঞ্চয়পত্রে রয়েছে। পাঁচ বছর আগে তাঁর মোট অস্থাবর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার মতো।

সাইফুজ্জামান চৌধুরী
সাইফুজ্জামান চৌধুরী


জাবেদের সম্পদ কমেছে, স্ত্রীর বেড়েছে
ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের আয় এবং অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে কমেছে। বেড়েছে স্থাবর সম্পদের পরিমাণ। তবে একই সময়ে তাঁর স্ত্রীর সম্পদ ও আয় বেড়ে গেছে। লাভজনক পদ ছেড়ে দেওয়ায় আয় কমেছে বলে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী। 
সাইফুজ্জামানের বার্ষিক আয় পাঁচ বছরে কমেছে ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি ছিল সাড়ে ১২ কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ১২ লাখ টাকার। তবে স্থাবর সম্পদ ৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বেড়েছে। আগে স্থাবর সম্পদ ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। 
স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ আগে ছিল ৬৯ লাখ টাকার, এখন হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদ ২০ হাজার টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

শাহরিয়ার আলম
শাহরিয়ার আলম


শাহরিয়ারের ৬৬ কোটি
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ৬৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। ফলে হলফনামা অনুযায়ী সম্পদশালী মন্ত্রীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে রয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে তাঁর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৩ কোটি ১২ লাখ টাকার মতো। তাঁর স্ত্রীরও বেশ সম্পদ রয়েছে, যার পরিমাণ ৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে তাঁর স্ত্রীর সম্পদ ছিল ১ কোটি ৪ লাখ টাকার মধ্যে। 
শাহরিয়ার আলমের আয় ও সম্পদের বড় অংশ ব্যবসা থেকে আসছে। ২০১৪ সাল ব্যবসায় লোকসান উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এবার সেখান থেকে লভ্যাংশ পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে ৫৮ কোটি টাকাই বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগ। ৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার নগদ ও ব্যাংক জমার অর্থ আছে তাঁর। স্ত্রীর সম্পদের মধ্যে নগদ ও ব্যাংকে আছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকার মতো। শেয়ারবাজারে (সেকেন্ডারি বাজার) তাঁর স্ত্রীর বিনিয়োগ ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। 
শাহরিয়ার আলমের বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে লভ্যাংশের পরিমাণ ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার মতো। ২০১৪ সালের হলফনামায় তিনি ব্যবসায় বছরে ২৫ লাখ টাকার মতো লোকসান হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছিলেন।

নুরুজ্জামান আহমেদ
নুরুজ্জামান আহমেদ


টাকা বেড়েছে নুরুজ্জামানের
সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সবচেয়ে বেশি আয় আসে মাছ চাষ থেকে, পাঁচ বছরে যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। হলফনামায় ৩৫ বিঘার একটি মৎস্য খামারের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। 
প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ বেশির ভাগ বেড়েছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকায়। ২০১৪ সালে এ খাতে তাঁর মোট ৮৬ হাজার টাকা ছিল, এখন যা ২ কোটি ৪৮ লাখ টাকায় উঠেছে। নুরুজ্জামান আহমেদের বার্ষিক মোট আয় প্রায় ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা আসে মাছ চাষ থেকে, যা ২০১৪ সালে দেড় লাখ টাকা ছিল। তামাক ব্যবসা ও ব্যাংকে জমা টাকার সুদ থেকে আসে সাড়ে ৭ লাখ টাকার মতো।

কাজী কেরামত আলী
কাজী কেরামত আলী


কেরামতের বাকি ২৬ লাখ টাকা
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর বাড়ি করার সময় মালামাল কিনে প্রায় ২৬ লাখ টাকা বাকি রেখেছেন, যা উল্লেখ করেছেন হলফনামায়। উত্তরায় তিনি একটি সাততলা বাড়ি করেছেন, এ জন্য ৩৫ লাখ টাকার গৃহঋণও আছে তাঁর। 
কেরামত আলীর আয় ও সম্পদ অন্যদের তুলনায় কম। মন্ত্রী হওয়ার পর অবশ্য তা বেড়েছে তাঁর। দশম সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, কেরামত আলীর বার্ষিক আয় ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো, যা এখন ৫৩ লাখ ৪৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এর সাড়ে ৩৭ লাখ টাকাই মন্ত্রী ও সাংসদ হিসেবে পাওয়া ভাতা। 
প্রতিমন্ত্রীর ব্যাংকে জমা টাকার পরিমাণ সাড়ে ২১ লাখ, সঞ্চয়পত্র বা আমানতে আছে ২ লাখ ৭২ হাজার ও একটি গাড়ির মূল্য বাবদ আছে সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার সম্পদ।