পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন আজও সক্রিয় বাংলাদেশে
পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছে ১৯৬৫ সালে তালিম নিয়েছিলেন বিটলসের অন্যতম গায়ক জর্জ হ্যারিসন। ১৯৬৮ সালে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়। তিনি সেতার ছাড়লেন। কিন্তু ‘গুরুদক্ষিণা’ বাকি রয়ে গিয়েছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। অগণিত মানুষ শহীদ হতে লাগল, কোটি মানুষ ভিটেছাড়া। জন্মভূমির মানুষের জন্য রবিশঙ্করের প্রাণ ডুকরে কেঁদে উঠল। জর্জ হ্যারিসনের কাছে যেন গুরুদক্ষিণা চাইলেন তিনি। বললেন, যুদ্ধে আক্রান্ত অসহায়দের জন্য কিছু করতে হবে। দুজনে ঠিক করলেন, বাংলাদেশের মানুষের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য একটি কনসার্ট করা হবে। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হলো ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
কনসার্টের শুরুতে বাংলাদেশের পল্লিগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটা পরিবেশনা করেন শাস্ত্রীয় সংগীতের গুরু রবিশঙ্কর। আর শেষে নিজের লেখা ও সুরে ৪০ হাজার মানুষের সামনে জর্জ হ্যারিসন গাইলেন, ‘বন্ধু আমার এল একদিন/ চোখ ভরা তার শুধু হাহাকার/ বলল কেবল সহায়তা চাই/ বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার/ বেদনা যদিবা না-ও থাকে তবু/ জানি আমি, কিছু করতেই হবে/ সকলের কাছে মিনতি জানাই/ আজ আমি তাই/ কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই/ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ/’ (অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ)
জর্জ হ্যারিসন আত্মজীবনীমূলক বই আই মি মাইন-এ লিখেছেন, তাঁর রাগা অ্যালবামের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে কাজ করেছিলেন তিনি। তখন রবিশঙ্কর প্রস্তাবটি দেন।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এ ধরনের বড় অনুষ্ঠান ওটাই ছিল প্রথম। বিশ্বে এ পর্যন্ত যত চ্যারিটি কনসার্ট হয়েছে, তার মধ্যে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের যে প্রভাব, তার তুলনা কমই আছে। আই মি মাইন বইয়ে হ্যারিসন লিখেছেন, ‘এখনো বাঙালি রেস্তোরাঁয় এমন সব ওয়েটারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যাঁরা বলেন, “ওহ্, মিস্টার হ্যারিসন, আমরা যখন জঙ্গলে লড়াই করছিলাম, তখন বাইরে কেউ আমাদের কথা ভাবছে, এটা জানাটাও আমাদের জন্য ছিল অনেক কিছু।”’
২০০১ সালে জর্জ হ্যারিসন মারা যান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে তিনি এখনো সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ নামে শিশুদের জন্য কল্যাণমূলক একটি তহবিল আছে। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবাম বিক্রির অর্থ সেখানেই জমা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য একাধিক কর্মসূচিতে ব্যবহৃত হয়েছে সেই অর্থ। জর্জ হ্যারিসন এবং কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আজও সক্রিয় বাংলাদেশে।
২০১২ সালে মারা যান পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তার আগে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামের ডিভিডি। তার ভূমিকায় নড়াইলের সন্তান রবিশঙ্কর লিখেছিলেন, ৭৫ বছরের সংগীতজীবনে তিনি যত কনসার্ট করেছেন, তার মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সম্মাননা দিয়ে এই মহান বন্ধুর প্রতি সম্মান জানায়। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনকে সম্মান জানিয়ে প্রথমা প্রকাশন বের করেছে টু ফ্রেন্ডস, ওয়ান কজ: রিমেমবারিং দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামে একটি বই।