'পলিটিকস ঘুইরা গেছে'

মাইক নিয়ে প্রচারে নেমেছেন সাদেক খানের সমর্থকেরা। মঙ্গলবার দুপুরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা। ছবি: প্রথম আলো
মাইক নিয়ে প্রচারে নেমেছেন সাদেক খানের সমর্থকেরা। মঙ্গলবার দুপুরে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা। ছবি: প্রথম আলো

ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে ঢাকা-১৩ আসনে। মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরে বাংলা রোড নিয়ে এই আসন। ওইসব এলাকার বাজারে-চায়ের দোকান, পাড়া-মহল্লা সর্বত্রই কেবল রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা। 

এলাকার ভোটারদের ভাষ্য, এই আসনে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাদেক খান ও বিএনপির আবদুস সালাম। এর বাইরে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী শফিকুল ইসলাম সেন্টু আসায় ভোটের সমীকরণ বদলে গেছে। তিনজনেরই নিজস্ব ভোট আছে। তাই এখন লড়াই হবে ত্রিমুখী। এক ভোটার মজা করে বলেই ফেললেন, নৌকা আর ধানের শীষের দুই প্রার্থীর মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এসে ‘পলিটিকস ঘুইরা গেছে’।

এই আসনের মোহাম্মদপুর, টাউন হল, কাটাসুর, বাঁশবাড়ি, শেখেরটেক, আদাবর, শিয়া মসজিদসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচনের আমেজ আসতে শুরু করেছে এসব এলাকায়। তবে প্রচারণায় কেবল সরকারদলীয় প্রার্থী সাদেক খানের পোস্টার ও ব্যানারই বেশি। বিএনপির প্রার্থী আবদুস সালামের প্রচারণার ছিটেফোঁটাও নেই। এর বাইরে সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী খান আহসান হাবীরের ব্যানার ও পোস্টার দেখা গেছে।

মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের একটি চায়ের দোকানে জনা দশেক মানুষ। তাঁদের আলোচনার বিষয় বর্তমান রাজনীতি ও নির্বাচন। ক্রেতারা নির্বাচনের প্রার্থী নিয়ে কথা বলছেন সেই কথার পিঠে আরেক কথা ছুড়ে দিচ্ছেন চায়ের দোকানদার মো. হোসেন। তিনি জানালেন, ১৯৪৫ সাল থেকে মোহাম্মদপুর এলাকায় আছেন। এখানকার রাজনীতির নানা পরিবর্তন হয়েছে তাঁর চোখের সামনেই। এদিকে ভোটের হাওয়া কেমন—জানতে চাইলে ফিক করে হেসে বললেন, দেখতাছেন না দোকানের সক্কলে মিলা ভোটের কথাই কইতাছে। আমিও শুনতাছি। তিনি জানালেন, গতকাল দুপুর থেকে টাউন হল এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদেক খান প্রচারণা শুরু করেছেন ও পোস্টার লাগিয়েছেন। কালকে থেকেই নির্বাচনী আমেজ চলে এসেছে তাঁদের এলাকায়।

জাকির হোসেন রোডের ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল। ১৯৯৪ সালে মাদারীপুরের কালকিনি থেকে এসে মোহাম্মদপুরে ঘড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ভোটারও হয়েছেন ঢাকার। তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রার্থীদের কাউরে অখনো মাঠে দেখা যায় নাই। গতকাল রাতে নৌকার মিছিল হইছে। কে জিতব বলা যায় না। তবে ভালো ভোট হইলো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হইবো। আর তা না হইলো সরকার ছাড়া কেউ পাত্তা পাইব না।

বসিলা ওয়াসপুর ব্রিজের সামনে কথা হয়, শফিকুল ইসলাম (৫৭) ও গনু মিয়া (৬০)। তাঁরা বলেন, এই এলাকার সন্তান সাদেক খান। এইখানে আর কেউ জিতব না। অখন আপনিই বুইঝা লন আমরা কারে ভোট দিমু।

কাটাসুর এলাকায় মকবুল হোসেন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট নিয়ে কথা বলছিলেন মধ্যবয়স্ক দুই মানুষ। তাঁদের একজন মাজেদুল হক বলছিলেন, এই এলাকার মানুষ উন্নয়নে যাকে পাশে পাবেন তাঁকেই নির্বাচিত করবেন। একটু বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই এলাকায় বড় প্রার্থী আছেন তিনজন। আওয়ামী লীগের সাদেক খান, বিএনপির আবদুস সালাম আর জাতীয় পার্টির সেন্টু সাহেব। তাঁরা এখনো ভোট চাইতে আসেন নি। যার কথা আর প্রতিশ্রুতি ভালো লাগবে তাকেই ভোট দেব আমরা। তাঁর কথার সঙ্গে কথা মিলিয়ে বলছিলেন এই এলাকার বাসিন্দা অবদুর রব। তিনি বলেন, আমরা মুখ দেখে ভোট দেব না। যে মন জয় করতে পারবে তাঁরই পাল্লা ভারী হবে।

সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী খান আহসান হাবীরের ব্যানার। ছবি: প্রথম আলো
সিপিবির কেন্দ্রীয় সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থী খান আহসান হাবীরের ব্যানার। ছবি: প্রথম আলো

এই এলাকায় থাকতে থাকতে হঠাৎ মাইকের শব্দ শোনা গেল। কাছে গিয়ে দেখা গেল রিকশায় মাইক লাগিয়ে সাদেক খানের প্রচারণা চালাচ্ছেন দুই কর্মী। তাদের একজন সেলিম বললেন,গতকাল থেকেই তারা এই কাজ শুরু করেছেন। সাদেক খানের নির্বাচনী এলাকা গুলোতে তাঁরা মাইক দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন ও পোস্টার বিতরণ করছেন।

মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ব্যানার ও পোস্টার। একটি কক্ষে দলীয় নেতা কর্মীদের ভিড়। তাঁরা জানালেন, তাঁরা সাদেক খানের নির্বাচনে প্রচারণার জন্য কাজ করছেন পাশাপাশি মানুষের কাছে জনসমর্থন আদায় করার জন্য যাচ্ছেন।

ভোটের আমেজের সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক খবরের কাগজের দোকানেও ভিড় বেড়ে গেছে। মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকায় প্রবেশ মুখেই একটি খবরের কাগজের দোকান থেকে তিনটি পত্রিকা নিয়ে পাশের চায়ের দোকানে এসে বসলেন আদাবরের বাসিন্দা আবু তাহের ও শেখেরটেকের বাসিন্দা আহসানুল কবীর ও মোহাম্মাদিয়া হাউজিংয়ের বাসিন্দা আবদুল মোমেন। তিনজনই চা খাচ্ছেন আর ফাঁকে ফাঁকে নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। আবু তাহের বলছিলেন, নৌকা আর ধানের শীষের লড়াই হবার কথা আছিলো। অখন তো লাঙলও আইসা পড়ছে। পলিটিকস ঘুইরা গেছে। লড়াই হইবো ত্রিমুখী। তাঁর কথায় সায় দেন আহসানুল কবীর। তিনি বললেন, তিন প্রার্থীর কেউ কারও চেয়ে কম না। সবারই নিজেদের দলীয় ভোট পাবে। ফলে সমীকরণ হবে আলাদা। শেষমেশ কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে, সেটা বলা মুশকিল।

শফিকুল ইসলাম সেন্টুর বাসা মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি তাজমহল রোড, টাউন হল, সলিমুল্লাহ রোড, টিক্কাপাড়া, শের শাহ রোডের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। তাই এই আসন নিয়ে আগাম কিছু বলা যাচ্ছে না। আবুল মোমেন জাপান গার্ডেন সিটির সামনে ব্যবসা করেন। তিনিও একই মত দিলেন।

নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাদেক খান। মঙ্গলবার দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমাদের ১৪২টি কেন্দ্র কমিটি মাঠে কাজ করছে। তাঁর সঙ্গে কাজ করছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উপ প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল হক রানা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আমরা গতকাল দুপুরের পর থেকে প্রচার শুরু করেছে। গতকাল ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে জনসংযোগ করেছি। আজ ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচার চালাচ্ছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়ার্ডে কাজ করার পর রাতে উঠান বৈঠক করছি।

বিএনপি প্রার্থী আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, আমরা আজ থেকে প্রচারণা শুরু করেছি। প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পোস্টার ও ব্যানার চলে গেছে। পুরোদমে কাজ শুরু হয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিদিন তাঁর নেতা-কর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গতকালও আজিজ নামে এক নেতাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচন করা কষ্টকর হয়ে যাবে।