সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ চায় প্রশাসন

>

• বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভা হয়
• আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় নানা প্রস্তাব উঠে আসে
• প্রস্তাবের বিষয়ে ইসি তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি
• কেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার না করতে নির্দেশ আসতে পারে
• ভোটের আগে-পরে ৭২ ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমানো হতে পারে

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থেকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ, ভোটের আগে ইন্টারনেটের গতি কমানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ রাখাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় সভায় এসব প্রস্তাব উঠে আসে। অপপ্রচার ঠেকানো ও নির্বাচন সুষ্ঠু করার স্বার্থে এসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে তাঁরা মনে করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ, র্যাব, বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) ও রিটার্নিং কর্মকর্তারা (জেলা প্রশাসক) সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তবে ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার না করতে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া ভোটের আগে-পরে ৭২ ঘণ্টা ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মুঠোফোন নেটওয়ার্ক টু-জি করে রাখা হবে।

সূত্র জানায়, সভায় নির্বাচনী প্রচারে হামলা-সংঘাতের বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত ১০ জন কর্মকর্তা ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাব করেন। কেউ কেউ মুঠোফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া এবং ভিডিও করতে না দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা বলেন, সাংবাদিক বা ভোটাররা ফোন নিয়ে ভোটকেন্দ্রে ঢুকে অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ–মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করেন। ভিডিও করে তা সম্পাদনা করেও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। এর ফলে ভুল তথ্য প্রচার হয়ে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের পরিচয়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ দেন। তিনি যুক্তি দেখান, অনেক নামমাত্র পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নিজস্ব ‘অ্যাজেন্ডা’ নিয়ে কাজ করেন।

সভায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব সাংবাদিকদের বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ বলা যাবে না। তাঁরা যেটা বলেছেন, কার্ড ছাড়া যেন কোনো সাংবাদিক ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ না করেন। কারণ, অনেকগুলো অনলাইন পত্রিকা আছে, যেগুলো ভুয়া।

সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, পর্যবেক্ষকদের জন্য ইসির নীতিমালা আছে। সাংবাদিকদের জন্যও পরিচয়পত্রে নির্দেশনা দেওয়া থাকে, তাঁরা কী করতে পারবেন, আর কী করতে পারবেন না। সাংবাদিকদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া যাবে না। তবে টিভি চ্যানেলগুলো যাতে ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে সরাসরি সম্প্রচার না করে, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য ইসির নেই।

সভায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনেককে ভোটের কাজে সম্পৃক্ত করা হতে পারে। এ ছাড়া ভোট সামনে রেখে কোনো কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হামলার আশঙ্কার কথাও বলেন একজন কর্মকর্তা। বৈঠকে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা তোলা হচ্ছে। এগুলো কোথায় যাচ্ছে, কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সভা শেষে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিকেরা মুঠোফোন নিয়ে যেতে পারবেন, ভোটকেন্দ্রেও ঢুকতে পারবেন। তবে কেউই সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন না। সচিব বলেন, মুঠোফোনে ভোটারদের বিভিন্ন দৃশ্য ধারণ করে তা ফেসবুকে দিলে তা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসত্য খবর দেওয়া হয়।

ভোটকেন্দ্রের ভেতরে কোনো অনিয়ম হলে সাংবাদিক বা অন্যরা কী করবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ফোন দিয়ে ছবি তোলার বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে অপ্রীতিকর কিছু দেখলে তাঁরা নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করতে পারবেন। সরাসরি সম্প্রচার (লাইভ) করতে পারবেন না। এ ছাড়া কেন্দ্রে প্রার্থী, ভোটার বা অন্যদের মুঠোফোনে কথা বলার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছে ইসি।

হেলালুদ্দীন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভোটের সময় অনেক ভুয়া খবর দেওয়া হয়, অপব্যবহার করা হয়। তাই ভোটের সময় এটা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হচ্ছে। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক টু-জি করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে কী করা হবে, তা পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ রাখা। সরকার সবার প্রতি সমান আচরণ করলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা সম্ভব। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যদি নির্বাচন হয়, তবে এই নির্বাচন অবশ্যই স্বচ্ছ ও শুদ্ধ হতে হবে।

সভায় নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ঢাকা-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাককে আটকের বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাতে পারেননি। তিনি কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আইন-বিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন।

নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং বাড়ি ফিরে যাবেন, এটা নিশ্চিত করতে হবে। আরেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, প্রার্থীরা প্রচার চালাবেন, ভোটাররা ভোট দেবেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

ইসি সচিব প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধের মামলা নেই, এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করার নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন বাহিনীকে সমন্বয় করে কাজ করতে সভায় বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বৈঠকের বিভিন্ন প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, যে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে তা আত্মঘাতী বলা যায়। নির্বাচন কমিশন যদি অবাধ নির্বাচন করতে চায়, তাদের পুলিশ ও প্রশাসনের এসব প্রস্তাব একদম আমলে নেওয়া ঠিক হবে না।

ড. সাখাওয়াত বলেন, ‘আমরা তো চাই সারা দেশের নির্বাচন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারিত হোক। কিন্তু এসব করে ইসি গণমাধ্যমকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে। ইসি এমন সিদ্ধান্ত নিলে জনগণ তাদের সন্দেহ করবে। আর সন্দেহ থাকলে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। পাশাপাশি কমিশন নিজস্ব ক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।’ তাঁর মতে, গণমাধ্যম হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সহায়ক শক্তি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে গণমাধ্যম ইসির প্রতিপক্ষ। আর প্রতিপক্ষকে রুখতেই যেন তারা এসব চিন্তাভাবনা করছে।

সেনা নামবে ২৪ ডিসেম্বর
২৪ ডিসেম্বর থেকে মাঠে নামবে সশস্ত্র বাহিনী, থাকবে আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত। গতকাল রাতে ইসি সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের কাছে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, ২২ ডিসেম্বর বিজিবি মোতায়েনের আলোচনা হয়েছে, শনিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের নিবন্ধিত শরিক দলের প্রার্থীদের পোস্টারে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছবি ব্যবহারের বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, নিবন্ধিত কোনো দলের প্রার্থী তাঁদের জোটের প্রতীক ব্যবহার করতে পারলেও ওই দলের প্রধানের ছবি পোস্টারে ব্যবহার করতে পারবেন না। যাঁরা দলের মনোনীত প্রার্থী, তাঁরাই কেবল দলীয় প্রধানের ছবি ব্যবহার করতে পারবেন।