নির্বাচন অবাধ হলে ভোটের হার বাড়ে

>

• ১০ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ
• নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়।
• দলীয় সরকারের দুই নির্বাচনে ভোট পড়েছে সবচেয়ে কম।

ভোটদানের হার সবচেয়ে বেশি ছিল ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে। ভোট পড়েছিল ৮৭ শতাংশ। গত ১০টি সংসদ নির্বাচনের ভোটের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ভোট যে নির্বাচনগুলোতে পড়েছিল, সেগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ব্যতিক্রম কেবল ১৯৯১ সাল—ওই নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

এই তথ্য বলছে, নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হলে ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়ে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হয়। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত হন। নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ভোটকেন্দ্রে নারীরাও বেশি সংখ্যায় যান।

পরিসংখ্যান বলছে, একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনে খুব কম ভোট পড়ে। ভোট পড়ার হার সবচেয়ে কম ছিল বিএনপি আমলে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে—১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে। তারপর কম ভোট পড়েছে আওয়ামী লীগ আমলে দশম সংসদ নির্বাচনে—২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অর্থবহ নির্বাচন হলে মানুষ ভোট দেয়। আর এটা পরিষ্কার যে এই দুটি নির্বাচন অর্থবহ ছিল না।’

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। ভোটার তালিকা ছিল নতুন। পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ব্যবহৃত ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছিল ৫৭ লাখ ২৬ হাজার ১৫৬ জন। দেশে তখন মোট ভোটার ছিল ৩ কোটি ৫২ লাখের কিছু বেশি। ভোট পড়েছিল ৫৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। প্রদত্ত ভোটের ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ, আসন পেয়েছিল ২৯৩টি।

১৯৭০ সালের অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ প্রাদেশিক নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। দলটির ওই বিজয় দেশকে দ্রুত স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ৮৯ শতাংশ পেয়ে ৩০০ আসনের প্রাদেশিক পরিষদের ২৮৮টিতে জয়ী হয়। ভোট পড়েছিল ৫৮ শতাংশ। 

পঁচাত্তর–পরবর্তী তিন নির্বাচন
১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর দেশে সামরিক শাসন চলে দীর্ঘ সময়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালে। অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুটি অংশ (মালেক ও মিজান) এতে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫১ শতাংশ।

এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনামলে দুটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্যান্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগও অংশ নেয়, বিএনপি অংশ নেয়নি। এই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬১ শতাংশ। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে এই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৮ শতাংশ। এই তিন নির্বাচন সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সামরিক সরকারের অধীন এসব নির্বাচন সুষ্ঠুও ছিল না, অবাধও ছিল না। এসব নির্বাচনের যেসব তথ্য নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া যায়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। 

তত্ত্বাবধায়কের চার নির্বাচন
এরশাদ সরকারের পতনের পর গঠিত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই ব্যবস্থায় ১৯৯১ সালে দেশে পঞ্চম জাতীয় সংসদ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সব বড় দল অংশ নিয়েছিল। এই নির্বাচনে ভোটারদের ৫৫ শতাংশ ভোট দিয়েছিল। ক্ষমতায় আসে বিএনপি।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের মোর্চা বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ (বামাসপ) চার হাজার পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বামাসপের সভাপতি ফাদার আর ডব্লিউ টিম। বামাসপের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া এই নির্বাচনে দৃশ্যমান কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে ছিল ভোটকেন্দ্র বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্য, ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি কম, কর্মীদের মধ্যে নির্বাচনী আইন মানায় সচেতনতা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া।

বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর ১৯৯৬ সালের জুনে সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সব দল তাতে নেয়। এতে রেকর্ড ৭৬ শতাংশ ভোট পড়ে। বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০১ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ে ৭৫ শতাংশ। বিজয়ী হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালে। ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। এটিই দেশে সংসদ নির্বাচনে ভোটদানের সর্বোচ্চ হার।

এই নির্বাচনে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছিল। তালিকায় ভোটারের ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই নির্বাচনে প্রথম ‘না’ ভোটের বিধিন রাখা হয়। এই দুটি বিষয়ও কেন্দ্রে ভোটার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল বলে অনেকের ধারণা। 

দলীয় সরকারের দুই নির্বাচন
সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দুটি নির্বাচনে। এর প্রথমটি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নামে খ্যাত ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ সব প্রধান দল বর্জন করেছিল। ভোট পড়েছিল ২১ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে দেশের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এই নির্বাচন শুধু বর্জনই করেনি, প্রতিহত করারও ডাক দিয়েছিল। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ভোট হয়েছিল ১৪৭টি আসনে। নির্বাচন কমিশন বলছে, ১৪৭টি আসনের ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল। দেশের মোট ভোটারের হিসাবে এই হার ১৯ শতাংশ।

এবার একাদশ সংসদ নির্বাচন হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। সব রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নিচ্ছে। দেশে এখন ভোটার ১০ কোটি ৪০ লাখের ওপর। এদের কত শতাংশ ৩০ ডিসেম্বর ভোটকেন্দ্রে যাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।