দেশজুড়ে চলে বুদ্ধিজীবী নিধন

বাসার দেয়ালে ঝোলানো সাঈফ মীজানুর রহমানের ছবি, স্বাধীনতা সম্মাননা সনদ, ডাকটিকিট দেখাচ্ছেন তাঁর ছোট বোন আফরোজা পারভিন। ছবি: প্রথম আলো
বাসার দেয়ালে ঝোলানো সাঈফ মীজানুর রহমানের ছবি, স্বাধীনতা সম্মাননা সনদ, ডাকটিকিট দেখাচ্ছেন তাঁর ছোট বোন আফরোজা পারভিন। ছবি: প্রথম আলো

স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে ও বিজয় অর্জনের আগে পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক আর প্রকৌশলীদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছিল তারা। তবে দেশের অন্যান্য প্রান্তেও হত্যার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতির সেবকেরা। বাংলা একাডেমির ‘স্মৃতি ৭১’ গ্রন্থে এমন শতাধিক মানুষের স্মৃতিচারণা স্থান পেয়েছে।

এই প্রতিবেদনে থাকছে সাঈফ মীজানুর রহমানসহ এমন পাঁচজন মানুষের কথা।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রাগার খুলে দিয়েছিলেন সাঈফ
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাঈফ মীজানুর রহমান পিরোজপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রেজারি কর্মকর্তা। বাবা ভাষাসৈনিক ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অন্যতম সদস্য মৌলভি আফসার উদ্দীন আহমেদ। ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী সাঈফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ার সময় ফজলুল হক ছাত্র সংসদের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েও রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসেননি। তাই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পরই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন। ট্রেজারি থেকে টাকা আর অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, গণহত্যার ছবি ভারতে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিলেন। নিজের অবস্থান নিয়ে লুকোচুরি ছিল না। ১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তানি বাহিনী যখন পিরোজপুর আক্রমণ করল, তখন প্রথম ধাক্কাতেই তুলে নিয়ে যায় সাঈফ মীজানুর রহমানকে। 

সাঈফ মীজানুর রহমানকে জিপের পেছনে বেঁধে গোটা পিরোজপুর শহর ঘুরিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পরে তাঁকে গুলি করে বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। আদরের বড় ছেলে যে আর নেই, সে খবর মা মতিয়া আহমেদ জেনেছিলেন অনেক পরে। তিনি পায়ে হেঁটে পথে-প্রান্তরে ছেলের লাশ খুঁজে বেরিয়েছেন। কিন্তু ছেলের লাশ পাননি। 

গতকাল বৃহস্পতিবার কথা হচ্ছিল তাঁর ছোট বোন আফরোজা পারভিনের সঙ্গে। পান্থপথে তাঁর বাসার দেয়ালে ভাইয়ের ছবি, স্বাধীনতা সম্মাননা সনদ, ডাকটিকিট। খুব যত্নে তোলা আছে সাঈফের ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়া অপ্রকাশিত ‘ক্রান্তিকালের আকাশ’নাটকের পাণ্ডুলিপি। ভাই হারানোর ৪৭ বছর পর তাঁর গল্প শোনাতে গিয়ে আফরোজা কখনো হাসলেন, কখনো ব্যথায় কাতর হলেন, কখনো প্রকাশ করলেন ক্ষোভ।

আফরোজা পারভিন বলছিলেন, এপ্রিলের শেষ দিকে মেজর এম এ জলিল সাঈফকে ভারতে চলে যেতে খবর পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই চলে গেলে চলবে কেন। ভেতরে থেকেও তো কিছু লোকের কাজ করা প্রয়োজন। বড়জোর মরব। তবু তো দেশের জন্য মরণ হবে।’

আফরোজা পারভিন বললেন, রণাঙ্গনে শহীদ নন—তাই সাঈফকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে রাজি নন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অজুহাত, সাঈফ বুদ্ধিজীবী। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার দূর-দূরান্তে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের অনেকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না।

খালেদ রশীদের মৃতদেহ কোথায়?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন খালেদ রশীদ। সহপাঠীরা ভালোবেসে ‘গুরু’ বলে ডাকতেন। প্রথমে খুলনা গার্লস কলেজে ও পরে সুন্দরবন কলেজে অধ্যাপনা করতেন। খুলনাতেই যুক্ত হয়েছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন সন্দীপনের সঙ্গে। একটা সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর সন্দীপনের কার্যক্রম পাল্লা দিয়ে উত্তপ্ত হতে শুরু করল। অসংখ্য ভালো গানের জন্ম দিয়েছিল এই সংগঠনটি। ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল/পাকে পাকে তড়পায় সমকাল’ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত হতো প্রায় প্রতিদিন। খালেদের বন্ধু কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক গতকাল প্রথম আলোকে শোনান তাঁর গল্প। তিনি বলছিলেন, খালেদ রশীদকে স্থানীয় পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল। ১৯৭১ সালের জুন-জুলাইয়ের দিকে পুলিশ খালেদকে ধরিয়ে দিতে তাঁকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, একটা সময় তো তাঁরাই খালেদ রশীদ ও তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে এটা প্রমাণের জন্য ঘুরঘুর করতেন। যখন পরিস্থিতি প্রতিকূলে, তখন ভোল পাল্টেছেন। তবে সত্যি ঘটনা হলো, যুদ্ধের সময়ও বার দুয়েক খালেদ রশীদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর। তিনি চেপে গিয়েছিলেন। তবে রাজাকাররা চুপ করে ছিল না। তারাই খালেদের খবর পৌঁছে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। খালেদ রশীদ ও তাঁর সহচরেরা ডুমুরিয়ায় আছেন, এমন খবর পেয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে ডুমুরিয়ায় যায় ওরা। অনবরত গোলা বর্ষণ করতে থাকে। একপর্যায়ে যে বাসায় বৈঠক চলছিল, সেখান থেকে খালেদ বেরিয়ে আসেন। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয় তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নইলে হত্যা করা হয়েছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে—এটুকুই জানা যায়।

পড়ে থাকা কঙ্কালের একটি হয়তো সিরাজুলের
ডানকান ব্রাদার্স টি গার্ডেনের সহকারী ম্যানেজার সৈয়দ সিরাজুল আবদালের শেষ সময়টাও ছিল নির্মম। বাংলা একাডেমির স্মৃতি ৭১-এ স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর মেয়ে সায়মা আবদাল। তিনি কথাগুলো শুনেছিলেন সিলেটের প্রাচীন পত্রিকা ‘যুগভেরী’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আমিনুর রশিদের কাছে। সিরাজুল ও আমিনুর রশিদ দুজনকেই সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে (সিলেট ক্যাডেট কলেজ) বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে আমিনুর রশিদ বেঁচে ফেরেন।

আমিনুর তাঁদের জানিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে শরীর থেকে রক্ত টেনে বের করে নেওয়া হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিরাজুল আবদালের স্ত্রী রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে স্বামীর খোঁজে গিয়েছিলেন। কিছু কঙ্কাল পেয়েছিলেন শুধু। তিনি ও তাঁর সন্তানেরা বাকি জীবন ওই সব কঙ্কালের কোনো একটি সৈয়দ সিরাজুল আবদালের—এই ভাবনাতেই কাটিয়েছেন। সৈয়দ সিরাজুল আবদাল কেন পাকিস্তানি আর্মিদের রোষের শিকার হয়েছিলেন?

স্বজনেরা বলেছেন, সত্তরের নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি বাংলা বর্ণমালার ছোট্ট একটা বই ছেপেছিলেন। বইগুলো চা-বাগানের সব উর্দুভাষী ম্যানেজার ও ইংরেজদের ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন। ভেতরে লিখেছিলেন, ‘এ দেশে থাকতে হলে বাংলাভাষা শিখতে হবে।’

বই হাতে পৌঁছানোর পর তারা জরুরি সভা ডেকেছিল। সভায় হাজির ছিল পাকিস্তানি সেনারাও। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এক দফা সৈয়দ সিরাজুল আবদাল গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। ১৯৭১ সালের ১৪ মে আবার তাঁকে পাকিস্তানি সেনারা তুলে নিয়ে যায়। কবে তাঁর মৃত্যু হয়, সে খবরও জানে না পরিবার।

বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েও থামেনি রাজাকারেরা
নওগাঁর নাট্যকর্মী বাসের আলী হুমকিতে ছিলেন ছোট ভাই আবদুল জব্বার শহীদ হওয়ার পর থেকেই। নাট্যাভিনেতা হিসেবে এলাকায় জনপ্রিয়তা ছিল। সেটাই কাজে লাগিয়ে স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময় ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ছোট ভাইটাকে খুঁজতেন তাঁদের মধ্যে। প্রায়ই বলতেন, যে জায়গায় আবদুল জব্বার শহীদ হয়েছেন—সেখানে যাবেন, ভাইয়ের সৎকার হয়নি, অন্তত একটা মিলাদ পড়বেন। আশা পূরণ হয়নি। বিজয়ের অল্প কদিন আগে ১২ বা ১৩ ডিসেম্বর তিনি নিহত হন। বাসের আলীর ছেলে এমদাদুল হক বলছিলেন, তাঁর বাবা হাটে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে হঠাৎ গুলির শব্দ পেয়ে চমকে ওঠেন তিনি ও তাঁর মা জিন্নাতুন্নেসা। কিছুক্ষণ পর বাজারের থলে হাতে দুই তরুণ আসেন। বলেন, ‘ভাবি, আপনাদের বাজার।’ তখনই তাঁরা বুঝে ফেলেন বাসের আলী আর নেই। তাঁর বাবাকে হত্যা করেছিল রাজাকার মোসলেমউদ্দীনের নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকারেরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তাঁরা পরে জানতে পারেন, রাজাকারেরা তাঁর কানে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছিল। তারপর বেয়নেট দিয়ে মৃতদেহটি খোঁচায়, লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নাচতে থাকে।

ছড়াকার আখতারের বাসার উল্টো দিকে রাজাকারের অফিস
ছড়াকার মুহম্মদ আখতার ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। স্মৃতি ৭১-এ তাঁর স্মৃতিচারণা করেছেন সৈয়দ শাহজাহান। ময়মনসিংহ থেকে আখতার ঢাকায় এসে দৈনিক ইত্তেফাকের সংশোধনী বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন পর ইত্তেফাকের চাকরি ছেড়ে রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা এলানে যোগ দেন। তখন থেকেই ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন তিনি। ওই চাকরিটাও ছেড়ে দিয়ে প্রথমে প্রিন্টিং ও প্যাকেজিংয়ের কাজে যুক্ত হন, পরে তাঁর ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয় ললনা নামের ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে যুক্ত হবেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার আগে তরুণদের তাঁর বাসায় আশ্রয় দিতেন, তারপর কুমিল্লার রামচন্দ্রপুর হয়ে আগরতলা যাওয়ার পথ চিনিয়ে দিতেন। তিনি জানতেন না বাসার উল্টো দিকে তাঁর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাজাকারেরা শাখা অফিস খুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অন্য সব বুদ্ধিজীবীর মতো তাঁকেও রাজাকার-আলবদরেরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।