ফেনীতে নিজামরাজ

নিজাম হাজারী
নিজাম হাজারী

: নির্বাচন হবে/হবে না
: ভোট সুষ্ঠু হবে না/শতভাগ সুষ্ঠু হবে
: ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না/যেতে পারবেন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের এই হলো পাল্টাপাল্টি সংলাপ। নির্বাচনের হালচাল জানতে গিয়েছিলাম দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনীতে। ৩০ ডিসেম্বরের বাকি মাত্র ১৫ দিন। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের শঙ্কা ও সংশয় কাটছে না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। কেউ একচুলও নড়তে নারাজ।

কিন্তু দলীয় বৃত্তের বাইরে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ, তাঁরা এখনো বিভ্রান্তিতে আছেন। আগের নির্বাচনগুলোর সঙ্গে এবারের নির্বাচনটি কোনোভাবে মেলাতে পারছেন না। অতীতে ‘একতরফা নির্বাচনেও’ মানুষ স্বাধীনভাবে মতামত রেখেছেন, নেতা-নেত্রীদের নাম ধরে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এবার ভোট নিয়ে কথা বলতে অনেকেই ভয় পাচ্ছেন। ফেনীতে এই ভয়ের মাত্রা আরও বেশি।

বুধবার সকালে ট্রাংক রোডে কথা হচ্ছিল স্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করি, কেমন ভোট হবে বলে মনে করেন? নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, মানুষ কেন্দ্রে যেতে পারলে এক রকম ফল হবে, যেতে না পারলে আরেক রকম। তিনি নিজেও নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘পরিবেশ ভালো থাকলে ভোট দিতে যাব। না থাকলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকব।’

মঙ্গলবার সকালে ফেনী পৌঁছে দেখি সবকিছু সুনসান। সড়কে, দেয়ালে শুধু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পোস্টার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, কার ঘাড়ে কটা মাথা অন্য দলের পোস্টার লাগাবে? ফেনী হলো বাংলাদেশের ভেতরে আরেকটি ‘রাষ্ট্র’। যখন যিনি সরকারি দলের সাংসদ থাকেন, তাঁর কথাতেই সবকিছু চলে। জেলা প্রশাসক ছাড়া এখানে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে যেসব কর্মকর্তা আছেন, তাঁরা অনেক দিন আগে পদায়িত হয়েছেন; সাংসদের চাহিদাপত্রমাফিক। তিনি যত দিন চাইবেন, তত দিন থাকবেন।

তাঁদের কথার সত্যতা পেলাম কিছুক্ষণ পর। স্থানীয় এক তরুণ সাংবাদিককে বললাম, বিএনপির সাবেক সাংসদ ভিপি জয়নালের সঙ্গে কথা বলতে পারি কি না। তিনি তাঁর বাসা চেনেন কি না। বললেন, ‘চিনি, তবে নিয়ে যেতে পারব না। কেননা তাঁর বাসার চারপাশে “পাহারাদার” আছে। আপনার সঙ্গে ভিপি জয়নালের বাসায় গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর যাবে সাংসদের কাছে। আপনি তো ঢাকায় গিয়ে নিরাপদ, কিন্তু আমাকে নাজেহাল হতে হবে।’ অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে ফেনী প্রেসক্লাব তিন বছর ধরে তালাবদ্ধ। কেউ কারও মুখ দেখেন না। কিন্তু সাংসদ নিজাম হাজারীর বাসায় তাঁর আমন্ত্রণে সবাইকে হাজির থাকতে হয়। এখন সাংবাদিকদের মিটিং পয়েন্ট সাংসদের বৈঠকখানা।

মন্ত্রী-সাংসদদের প্রটোকল দেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ফেনীতে সাংসদপত্নী কিংবা তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদেরও প্রটোকল দেওয়া কিংবা ফুল দিয়ে বরণ করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের গডফাদার বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা ফেনীতে গেলে লজ্জা পেতেন। কেননা সত্যিকার ‘পরিবাররাজ’ আছে ফেনীতেই। তবে ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজতন্ত্রও বদলে যায়।

আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০১) এখানে জয়নাল হাজারীরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘স্টিয়ারিং’ কমিটি নামে প্রথমে তিনি একটি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী করেছিলেন। তারপর এর নাম বদলে করেছিলেন ‘ক্লাস কমিটি’। এই কমিটির সদস্যদের হাতে লাঞ্ছিত বা নিগৃহীত হননি, এমন মানুষ খুব কম আছেন ফেনীতে। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভিপি জয়নালের রাজ কায়েম হয়। সেই ভিপি জয়নাল এখন নীরবে আসেন, নীরবে চলে যান। এমনকি একদা প্রচণ্ড প্রতাপশালী জয়নাল হাজারীও এখন ফেনীতে অবাঞ্ছিত। তিনি এখন আওয়ামী লীগের কেউ নন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে এলেও জয়নাল হাজারী মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ মনোনীত করেছিল আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে। তিনি যে বিএনপির ভিপি জয়নাল হাজারীর কাছে হেরে যান, তার পেছনে জয়নাল হাজারীর ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সাংসদ হয়ে আসেন জয়নাল হাজারীরই এককালীন শিষ্য নিজামউদ্দিন হাজারী। এখন সব অর্থেই শিষ্য গুরুকে ছাড়িয়ে গেছেন।

ফেনীতে পোস্টারের মতো নির্বাচনী ক্যাম্পও একতরফা। ‘আমাদের আর কোথাও কোনো শাখা নেই’-এর মতো শহরে দ্বিতীয় কোনো প্রার্থীর ক্যাম্প নেই। এ প্রসঙ্গে বিএনপির কর্মীরা অনেকটা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ভিপি জয়নাল এখন ঘরে লুকিয়ে আছেন। কিন্তু দলের দুরবস্থার জন্য তিনিও দায়ী। ক্ষমতায় থাকতে দলের সাধারণ নেতা-কর্মীরা নেতাদের কাছে ভিড়তে পারতেন না।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজামউদ্দিন হাজারীর খোঁজ নিতেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বললেন, তিনি বালিগাঁও ইউনিয়নের সুন্দরপুর স্কুলমাঠে গেছেন জনসভা করতে। রাতে ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এ রকম একজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা হলো। তিনি অন্তত দুজন বক্তার বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, যা হাস্যকর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ। একজন বলেছেন, ‘দেশের যে বিশাল উন্নয়ন হয়েছে, তাতে বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া বাইরে থাকলে নৌকা মার্কায়ই ভোট দিতেন।’ আরেকজন বলেছেন, ‘কেন্দ্রে বিএনপি থাকবে না। অন্য কোনো দলের এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’

উল্লেখ্য, ফেনীই একমাত্র জেলা, যেখানে বেশির ভাগ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সাংসদের ‘মনোনীত’ প্রার্থীর বাইরে কেউ মনোনয়নপত্র জমাই দিতে পারেননি।

তফসিল ঘোষণার পর ফেনীতে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদও জানিয়েছে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছে। আমরা ফেনীতে থাকতেই দেখলাম, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুবদলের কয়েকজন কর্মী প্রচার করতে নামলে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁদের মারধর করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন। পুলিশ বলছে, তাঁদের নামে ভয়াবহ নাশকতার মামলা আছে। মামলা থাকলেই ছাত্রলীগ তাঁদের মারধর করে পুলিশে দিতে পারে?
তবে স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এত কিছুর পরও ফেনীতে ক্ষমতাসীন দলটি ভোটের ফল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছে না। কেননা এটি খালেদা জিয়ার নিজের জেলা। জেলার তিনটি আসনই অতীতে বিএনপির দখলে ছিল। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা দেশে ভূমিধস বিজয় পেলেও ফেনীর তিনটি আসনেই হেরেছিল। এবার প্রার্থী বদল হলেও তিনটিতেই বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। একক প্রার্থী দিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী একজন। ফেনী সদরে নিজামউদ্দিন হাজারী। বাকি দুটি ছেড়ে দিয়েছে মহাজোটের দুই শরিক জাতীয় পার্টি ও জাসদকে।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী প্রথমে আওয়ামী লীগ থেকেই মনোনয়ন ফর কিনেছিলেন। কিন্তু এক দিন পরই নাটকীয়ভাবে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যপদ ও মনোনয়ন পেয়ে যান। এর পেছনে সরকারি দলের পরামর্শ ও সহায়তা কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা। অন্যদিকে জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারকে আওয়ামী লীগ ২০১৪-এর মতো আসনটি ছেড়ে দিলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তা সহজে মানতে পারেননি। দুই আসনেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। দলীয় প্রার্থী দেওয়ার দাবিতে তাঁরা অনশন, মানববন্ধন, অবরোধ ইত্যাদিও করেছিলেন।

এক-এগারোর পটপরিবর্তনের প্রধান কুশীলব মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সম্প্রতি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি পটপরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলেন বলেই আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়।

এরপর আওয়ামী লীগের বাকপটু নেতারা এক-এগারোর প্রধান কুশীলবদের গালমন্দ করার আগে অন্তত আয়নায় একবার নিজেদের মুখটি দেখে নিতে পারেন।