'টাইমস মেশিনে' ১৯৭১ গাথা

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের পক্ষে দেশটির তৎকালীন সরকার বেশ তৎপরও ছিল। তবে দেশটির স্বাধীন গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের লড়াই, বিজয়, গৌরব আর ধর্ষণের শিকার নারীর দুঃখগাথা প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে। একাধিক মার্কিন সাংবাদিক যুদ্ধের সময় ও আগে-পরে চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ। 

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের আর্কাইভ থেকে পাওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার নারী চোখে আগুন আর কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে ওই সময় বলেছিলেন, ‘একদিন বিচার হবেই।’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রত্যাশা যখন শুধু স্বপ্নের পাকে আটকে পড়েছিল, তখন কে জানত ওই নারীদের প্রত্যাশা ৩৯ বছর পর বাস্তবে ধরা দেবে! এক বৃদ্ধার হাহাকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আমার হয়তো বলা উচিত ছিল, একদিন তিনি ন্যায়বিচারের আদালতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবেন এবং ওই লোকগুলো তাদের কৃতকর্মের সাজা পাবে। আমি নিজের কথাতেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি।’

অপর এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ সফরে এসে ইয়াহিয়া খান ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর দায় চাপিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ক্ষমা চাওয়া ও জনবিক্ষোভের খবরও রয়েছে আর্কাইভে।

মুক্তিযুদ্ধের আগে–পরে বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের একাধিক প্রতিবেদন এর আর্কাইভে প্রিন্ট সংস্করণে সংরক্ষিত আছে। এই আর্কাইভকে ‘টাইম মেশিন’ বলে থাকে নিউইয়র্ক টাইমস।

এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস আন্তর্জাতিক অনেক সাংবাদিক খবর সংগ্রহ করেছিলেন। নিউইয়র্ক টাইমসে বড় পরিসরে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের খবরগুলো আন্তর্জাতিক পরিসরে পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের বিজয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি—এ দুটো বিষয় তখন এক হয়ে গিয়েছিল। বিজয়ের দিন যত এগিয়ে আসছিল, ততই বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের চাওয়া ছিল, স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে জীবিত পেতেই হবে।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘ঢাকা ক্যাপচার্ড’ প্রতিবেদন।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘ঢাকা ক্যাপচার্ড’ প্রতিবেদন।

দ্য রেপস অব বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধর্ষণের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে ১৯৭২ সালের ২৩ জুলাই অব্রে মিনেনের প্রতিবেদনটিতে। তিনি ঢাকাসহ বাংলাদেশের গ্রাম ও কলকাতা ঘুরে ধর্ষণের শিকার বাংলাদেশি নারীদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি করেন। হৃদয়ে ক্ষত পুষে বেড়ানো সেই নারীরা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অপরাধীদের শাস্তি চেয়েছিলেন, একদিন এ ঘটনার বিচার হবে বলে দৃঢ়তা প্রকাশ করেছিলেন।

ওই নারীরা হয়তো জানতেন না বিচারের দিনটি ঠিকই আসবে! স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ) গঠন হয়। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা কার্যকর করেছে ট্রাইব্যুনাল।

অব্রে মিনেনের সেই প্রতিবেদনে নোবেলজয়ী মাদার তেরেসার মন্তব্যও রয়েছে।

‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে নদী বয়ে চলা, আনন্দ ঝলমল, ফসলে ভরা বাংলাদেশের সবুজ গ্রামের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ছোটখাটো গড়নের লাজুক মানুষগুলো তাদের পরিবারকে ভালোবাসে, যে ভূমিতে তাদের জন্ম হয়েছে সেটিকে ভালোবাসে, তারা শান্তি ভালোবাসে।

ঢাকায় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৭ বছর বয়সী এক তরুণীর কথা তুলে ধরতে গিয়ে অব্রে মিনেন লেখেন, সৌন্দর্যের কারণে হিন্দু পরিবারের মেয়েটির পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। ওই গ্রামে তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে সম্পদশালী। বাবার পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় মেয়েটির। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রাতে ঘুমিয়ে থাকা পরিবারটির ওপর হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। স্বামীর সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটিকে ধর্ষণ করে ছয় সেনা। মেয়েটির এর পরের গল্প মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ নারীর মতো। গ্রাম থেকে বিতাড়িত হতে হয় তাঁকে। যে বাবার এত আদরের মেয়ে ছিলেন তিনি, সেই বাবাও লোকলজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেন। ঠাঁই হয় আশ্রয়কেন্দ্রে।

প্রতিবেদক জানতে চান তিনি গ্রামে থাকলেন না কেন? জবাবে মেয়েটি বলেন, ‘তারা আমাকে চায় না। বাবাও...।’ কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্বামী কখনো তাঁকে দেখতে এসেছিলেন? জবাব দেন, ‘না, তিনি অসুস্থ।’ আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিনিধির সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময়ে প্রতিবেদক বুঝে নেন, স্বামী অসুস্থ বলে দেখতে আসতে পারেন না—এমন বাক্যের মাঝেই সান্ত্বনা খুঁজে নেন মেয়েটি।

প্রতিবেদক জানান, তিনি যখন উঠে দরজার কাছে, তখন পেছন থেকে ‘হুজুর’ বলে ডাক দেন মেয়েটি। তিনি ফিরে তাকালে, দৃঢ় কণ্ঠে মেয়েটি বলেন, ‘আপনি দেখবেন একদিন ওই লোকগুলোর বিচার হবে।’ তিনি তিনবার উচ্চারণ করেন, ‘বিচার হবে, বিচার হবে, বিচার হবে।’

জানা যায়নি ওই নারী বেঁচে আছেন কি না বা তিনি এ দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম দেখেছেন কি না। তাঁর মতো আরও অনেকে এমন বিচার চেয়েছিলেন সেই দিন।

প্রতিবেদক অব্রে মিনেনের একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এক বৃদ্ধার কথা। যিনি তাঁর ১৩ বছরের নাতনিকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়েছিলেন চিৎকার করে। নাতনিকে রক্ষা করতে না পারার অনুতাপে জর্জরিত ছিলেন তিনি। শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ওই নারীর সঙ্গে কলকাতায় যখন প্রতিবেদকের কথা হয়, তখন তিনি শুধু হাহাকার করছিলেন আর নিজেকে দোষারোপ করছিলেন। বৃদ্ধা জানান, ঘটনার দিন নাতনিকে স্কুলে নেওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময় হঠাৎ জিপভর্তি পাকিস্তানি সেনারা এসে ছোঁ মেরে রাস্তা থেকে তাঁর নাতনিকে তুলে নেয়। তিনি জিপের পেছন পেছন চিৎকার করে দৌড়াতে থাকেন। একসময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কে জমে যান, দেখতে পান, কয়েকজন মিলে ঝোপের পাশে তাঁর নাতনিকে ধর্ষণ করছে। ধর্ষণ শেষে গুলি করে মেরে ফেলে তাঁর সামনেই।

প্রতিবেদকের কাছে বৃদ্ধা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি কিছু করতে পারলাম না। আমার ওকে বাঁচানো উচিত ছিল।’

প্রতিবেদনে প্রতিবেদক নিজের ভাষ্যে লেখেন, ‘আমি তাঁকে (বৃদ্ধা) বলি, তিনি যদি সেদিন তা করতেন, তাহলে আজ এই ঘটনা বলার জন্য বেঁচে থাকতেন না। আমার হয়তো বলা উচিত ছিল, একদিন তিনি ন্যায়বিচারের আদালতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে পারবেন এবং ওই লোকগুলো তাদের কৃতকর্মের সাজা পাবে। আমি নিজের কথাতেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি। কিন্তু তিনি (বৃদ্ধা) এ কথায় বিশ্বাস করেন, কারণ এটাই তাঁকে সান্ত্বনা দেয়।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা।

আরেক নারীর গল্প উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। কলকাতার ক্লিনিকে শান্ত কণ্ঠে নিজের সঙ্গে ঘটা দুর্বিষহ ঘটনার কথা বলেন ধর্ষণের শিকার দুই সন্তানের মা। তিনি জানান, ঘটনার দিন কয়েকজন সেনা একাধিকবার তাঁকে ধর্ষণ করে। সেই দৃশ্য তাঁর স্বামীকে দেখতে তাঁরা বাধ্য করছিল। তাঁর স্বামী সেনাদের গালি দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই নারীর ভাষায়, তাঁর স্বামী যে এমন সব গালি জানেন, তা তিনি নিজেও কখনো জানতেন। তবে এর ফল তাঁর স্বামীকে ভোগ করতে হয়েছে। সেনারা বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর স্বামীকে হত্যা করে। সেনারা চলে যাওয়ার পর তিনি ক্ষোভে–অপমানে কষ্টে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নেন। গলায় দড়ি প্যাঁচানোর সময় তাঁর দুই শিশুসন্তানের কান্নায় দড়ি ফেলে ওদের কোলে তুলে নেন। সন্তানদের নিয়ে সকালে একটি গাড়িতে করে রওনা দেন অনির্দিষ্ট যাত্রায়, মিশে যান শরণার্থীদের সঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তায় মাদার তেরেসার কর্মতৎপরতার উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তা করতে তিনিই প্রথম এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশে পাঁচটি পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। পরে সেই সংখ্যা ৬০ হয়। বাংলাদেশের নতুন সরকার তখন এ নিয়ে খুব কমই কাজ করছিল। মাদার তেরেসা তাঁর নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত কর্মীদের নিয়ে এই নারীদের জন্য কাজ করতে থাকেন।

মাদার তেরেসার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেদক বলেন, মধ্যবয়সী নারীর চেহারা জীর্ণশীর্ণ হলেও চোখ দুটো সতেজ। শান্ত চোখে রসবোধ খেলা করছে। এমন দৃষ্টি তিনি শুধু ২৩তম পোপ জন ও মহাত্মা গান্ধীর চোখেই দেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশ নিয়ে মাদার তেরেসা প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখনো হাজার কাজ করা বাকি।’ বিস্ময়কর শান্তভাবে তিনি বলেন, ‘একদিক দিয়ে এ ঘটনা ভালো হয়েছে। বাঙালিরা নিরীহ, অন্তত তাঁদের নিরীহ হয়েই থাকতে হয়। তাঁদের কিছু করার জন্য এমন একটি ঝাঁকুনি দরকার ছিল। শত শত নারী-পুরুষ এখন সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন। এই দুঃখজনক ঘটনা তাঁদের পুরুষদের বদলে দিয়েছে। আপনি কি জানেন, এই দুঃখী মেয়েদের বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছেন অনেক তরুণ।’ 

প্রতিবেদক মাদার তেরেসার কাছে জানতে চান, কোনো পুরুষ এই নারীদের এখনো পর্যন্ত বিয়ে করেছে কি না।
জবাবে মাদার তেরেসা বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত হয়নি। অনেক নারী গর্ভবতী। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এই নারীদের গর্ভপাতের সব প্রস্তুতি রাখলেও গর্ভপাতবিরোধী মাদার তেরেসার হাতে মায়ের গর্ভে থাকা এই শিশুদের বেশির ভাগই পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পাবে।

ঢাকা ক্যাপচার্ড
‘অ্যাটাকস সাসপেন্ডেড’ ও ‘ঢাকা ক্যাপচার্ড’ শিরোনামে দুটো প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক টাইমসে। দুটো প্রতিবেদনই করেন চার্লস মোরডেক। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে করা প্রতিবেদন দুটিতে যুদ্ধের সমাপ্তি, পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ ও পাকিস্তানে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি নিয়ে চলতে থাকা উদ্বেগের কথা জানানো হয়।

১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘ঢাকা ক্যাপচার্ড’ প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা দখলের পর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিয়েছে ভারত।

তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছেন যে যুদ্ধ চলছে এবং তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাবেন।

নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, রসদ সরবরাহে বড় ধরনের সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। যে পরিমাণ গোলাবারুদ ও জ্বালানি মজুত রয়েছে, তাতে দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ঢাকায় আত্মসমর্পণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন ভারতের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি। বাংলাদেশের বিদ্রোহী সরকারের চার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আগামীকাল ঢাকায় পৌঁছাবেন স্বাধীন সরকার গঠনের কাজ শুরু করতে। আজ আত্মসমর্পণের বিষয়টি একেবারেই সামরিক, সংকট সমাধানে এটা কোনো রাজনৈতিক চুক্তি নয়।

ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, আরও অনেক বিষয় সমঝোতার জন্য বাকি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য, পূর্ব বাংলার ক্যারিশমাটিক এই নেতা রাজদ্রোহের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী আছেন। ভারত শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে যতটা সম্ভব চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি (বঙ্গবন্ধু) অনেক জনপ্রিয়। তাঁকে বাঙালি ভূখণ্ডের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে, যিনি তাঁদের ভূখণ্ডের নাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ’। ভারতের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, তিনি মুক্ত না হলে পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলা হবে এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সেখানে ফুঁসে উঠতে পারে।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন জেনারেল নিয়াজি (ডানে)।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন জেনারেল নিয়াজি (ডানে)।

ভুট্টো ক্ষমা চেয়েছিলেন!
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভুট্টো। সেই সফরের সময়ে ১৯৭৪ সালের ২৯ জুন ঢাকা থেকে সাংবাদিক কস্তুরি রঙ্গনের পাঠানো ‘ভুট্টো রিগ্রেটস “ক্রাইমস” ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন। এ কর্মকাণ্ডকে ‘লজ্জাজনক দমন ও অবর্ণনীয় অপরাধ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলেও তিনি জানান, এতে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না। ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে ‘স্বার্থপর ও দূরদৃষ্টিহীন সামরিক শাসন’ ছিল।

ভুট্টো বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করবেন না যারা আপনাদের ও আমাদের শাসন করেছে। আপনাদের দুঃখ–কষ্টে আমাদের সমবেদনা জানাই, যে ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য শোক প্রকাশ করছি। সবশেষ নবীর নামে আপনাদের কাছে “তওবা” করছি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দিন সকালে ভুট্টো ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের সময় হত্যার শিকার বাঙালিদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শনে গেলে কয়েক শ লোক বিক্ষোভ করেন। তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন, ‘ঘাতক ভুট্টো, ফিরে যাও!’

পাকিস্তানি সূত্র এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে যে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে বিক্ষোভের সুযোগ দিল। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই বৈরিতা প্রদর্শন তারা ঠেকাতে পারবেন না। মানুষের মধ্যে এই বৈরী ভাব এখনো ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভুট্টোর ওই সফরের সময় দুটো বিষয়ে মীমাংসা চায় বাংলাদেশ। এক. বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া অবাঙালি মুসলিম। দুই. সম্পদের ভাগবাঁটোয়ারা।

পাকিস্তানি সূত্রের উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দাবি অনুসারে চার লাখ মুসলিম বিহারি, যারা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল, তাদের নাগরিকত্ব দেবে না পাকিস্তান। পাকিস্তান ১ লাখ ১৫ হাজার বিহারিকে গ্রহণ করতে রাজি আছে।

আর দ্বিতীয় ইস্যুটি হচ্ছে, সম্পদের বণ্টন হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে চার বিলিয়ন ডলার (৪০০ কোটি ডলার) দাবি করেছে।

এদিকে ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসার আড়াই মাস আগে ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিল ‘পাকিস্তান অফারস অ্যাপোলজি টু বাংলাদেশ’ বাংলাদেশ শিরোনামে দিল্লি থেকে বার্নার্ড ওয়াইনরাউবের পাঠানো প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। ১১ এপ্রিল প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যেভাবে দাবি করেছে, পাকিস্তান সেভাবে সরাসরি ক্ষমা চায়নি। পাকিস্তান সাদামাটাভাবে বলেছে, তাদের কিছু সেনা বাড়াবাড়ি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাত্রাতিরিক্ত ও বহুবিধ অপরাধের’ পাশাপাশি ‘যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যার’ অভিযোগে বাংলাদেশ ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে বিচারের মুখোমুখি করেছিল। ওই ১৯৫ জনকে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগের রাতে (৯ এপ্রিল) চুক্তি স্বাক্ষর হয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পক্ষে কামাল হোসেন, ভারতের স্বরান সিং এবং পাকিস্তানের আজিজ আহমেদ। ১০ এপ্রিল রাতে একযোগে ওই চুক্তি ঢাকা, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ থেকে প্রচার করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশে পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী ৯৩ হাজার সেনার সবাই কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তান ফিরে যাবে। ইতিমধ্যে ৮০ হাজারের বেশি সেনা পাকিস্তান ফিরে গেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানে আটকে পড়া ১ লাখ ১৭ হাজার বাঙালি বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। মোট ১ লাখ ৭৫ হাজার থেকে দুই লাখ আটকে পড়া বাঙালি ফিরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভুট্টোর ক্ষমা প্রার্থনা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশ সফরে এসে ভুট্টো যেভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন, তা কখনোই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাংলাদেশর আপত্তি রয়েছে তাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়ায় জাপানি সেনাদের ধর্ষণ ও হত্যার জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রী এখন ক্ষমা চাইলেও কোরিয়া তা গ্রহণ করেনি। মৌখিকভাবে নয়, প্রতিষ্ঠানগতভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি ছিল বাংলাদেশের, সেটি পাকিস্তান করেনি। ওই ১৯৫ জন সেনাকে বিচার করার কথা বলে চুক্তি স্বাক্ষর করে পাকিস্তান নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান তার কথা রাখেনি। ‘হামুদুর রহমান কমিশন’ গঠন করে মামুলি সাজার ব্যবস্থা করা হয়, দু-একটা পদচ্যুতি ও অব্যাহতি দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো সাজা দেওয়ার কথা শোনা যায়নি।

মফিদুল হক বলেন, গণহত্যার কোনো দায়মুক্তি নেই। ১৯৭১–এর যুদ্ধাপরাধের ন্যায়বিচার পেতে পাকিস্তানকে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের দাবি করা চার শ কোটি ডলার ফিরে পেতেও চাপ দিতে হবে।