বিশ্ব পাঠে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশের গণহত্যা

রায়েরবাজার বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালে
রায়েরবাজার বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালে
>
  • একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি
  • বিশ্বের বড় গণহত্যাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম
  • এই উপমহাদেশে এত বড় গণহত্যার নজির নেই
  • স্বীকৃতির জন্য দরকার গণহত্যাসংক্রান্ত উন্নত তথ্য-উপাত্ত

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে তারা যেমন গবেষণা করছে, তেমনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা-সম্পর্কিত বিভাগে এ নিয়ে পাঠদান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য এই ধারাকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা।

বাংলাদেশে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজও পাওয়া যায়নি। বিশ্বের বড় গণহত্যাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই উপমহাদেশে এত বড় গণহত্যার নজির নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে নেতিবাচক প্রচার ও বিভ্রান্তি ছিল দীর্ঘ সময়। ‘ভারত পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব’ ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংঘাত’, ‘গৃহযুদ্ধ’ ইত্যাদি তকমায় একে চিত্রিত করা হয়েছে। এই প্রচারণায় পাকিস্তান এবং এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধীদেরও সমর্থন ছিল। তিনি বলেন, ‘নেতিবাচক প্রচারের জবাবের জন্য শুধু নয়, ইতিহাসের স্বার্থেই এই গণহত্যার স্বীকৃতি দরকার।’

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলতে তিন ধরনের স্বীকৃতিকে বোঝেন গবেষকেরা। এর মধ্যে আছে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নথিতে এর উল্লেখ এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজের স্বীকৃতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, স্বীকৃতির জন্য দরকার গণহত্যাসংক্রান্ত উন্নত তথ্য-উপাত্ত। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমেই এর অর্জন সম্ভব। কারণ গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য প্রচুর তথ্য-উপাত্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হয়।

১৯১৫ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত আর্মেনিয়ায় সংঘটিত হয় গণহত্যা। ২০১৭ সালে এসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর স্বীকৃতি মেলে। ইমতিয়াজ আহমেদের বক্তব্য, ‘আর্মেনিয়া গণহত্যার শত বছর পর এর স্বীকৃতি মিলেছে। তাই আমাদের আশাহত হওয়ার কিছু নেই। এখন আশার কথা, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে।’

বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র স্যামুয়েল জেফি। তাঁর মাস্টার্সের গবেষণার বিষয় ছিল বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের গণহত্যার সময় এর প্রতিবাদে বিভিন্ন তৎপরতা। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এটি উপস্থাপন করা হয়।

গণহত্যা-সম্পর্কিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বইতে বাংলাদেশের গণহত্যা স্থান পাচ্ছে। উইলিয়াম ডি গোবিনস্টাইনের জেনোসাইড বইটিতে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে লেখা আছে। অ্যাডাম জোনসের জেনাসাইড: এ কমপ্রিহেনসিভ ইনট্রোডাকশন বইয়ের একটি অধ্যায় বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে। বইটি প্রথম প্রকাশের সময় বাংলাদেশের গণহত্যার উল্লেখ ছিল না। পরে এটি যুক্ত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ প্রোগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইন্দোনেশিয়াসহ মোট ১৪টি গণহত্যার উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ‘আদার’ বা অন্য গণহত্যার তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। বলা হয়েছে, এই গণহত্যার বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। বাংলাদেশের গণহত্যাকে ইয়েলের পাঠ্যসূচিতে স্থান দিতে ভূমিকা রেখেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বেন কিয়েরনান।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির কেন ইউনিভার্সিটির হলোকস্ট অ্যান্ড জেনোসাইড স্টাডিজে সংযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা। এই বিভাগের অধ্যাপক সু গ্রোনউল্ড ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘কম্বোডিয়ার গণহত্যা যতটা আলোচিত, সেই তুলনায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা কমই আলোচিত হয়। আমাদের শিক্ষার্থীরা ১৯৭১-এর গণহত্যা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।’ এখন অধ্যাপক সু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিএসে স্কাইপে ক্লাস নেন বলে জানান এর পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির রুটগার্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের পরিচালক অধ্যাপক আলেকজান্ডার হিনটন বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে আগ্রহী হয়ে বিভাগে এ-সংক্রান্ত পাঠদান শুরু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিসের উইন্টার স্কুল। এখানে হিনটনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যাবিষয়ক গবেষকেরা পাঠদান করেন।

জার্মানির ওলডেনবার্গ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ক্যাথরিন হফম্যান তুলনামূলক গণহত্যা অধ্যয়ন বিভাগে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ বছরের কোর্সে বাংলাদেশের গণহত্যাকে বিশেষভাবে পড়ানো হচ্ছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেও বাংলাদেশের গণহত্যা এখন স্বীকৃত হচ্ছে। গ্লোবাল অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট ম্যাস অ্যাটরোসিটি ক্রাইমস (গ্যামাক) সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশে সংঘটিত বড় অপরাধ ও গণহত্যার মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা এখন বিচার্য বিষয়।

৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েভানে গণহত্যা-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি বলেন, ‘তিন দিনের সম্মেলনে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয় সেখানে গুরুত্বসহকারে আলোচনায় এসেছে।’

এই উপমহাদেশেও বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাডেমিক স্তরে গণহত্যা নিয়ে পড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে কোর্স আছে। ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদের এক মাস পড়ান সেখানে। শহীদ কাদের বলছিলেন, ‘ভারতের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ কোর্স বলতে এটিই একমাত্র। এই কোর্সের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এখানে গণহত্যার পাশাপাশি একাত্তরে ভারতে থাকা শরণার্থী শিবিরে কলেরাসহ নানা রোগে বা অন্য কারণে মারা যাওয়া মানুষদের বিষয়ও আলোচ্য।’

পাকিস্তানেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহ বাড়ছে। পাকিস্তানের গবেষক আনাম জাকারিয়া বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে কাজ করছেন। এ বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণহত্যা-সম্পর্কিত সম্মেলনে তিনি আসেন। ফুটপ্রিন্টস অব পার্টিশন: ন্যারেটিভস অব ফোর জেনারেশন অব পাকিস্তানিস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস শীর্ষক বইয়ের এই লেখক বাংলাদেশের গণহত্যার কয়েকটি স্থান ঘুরেও দেখেন।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মফিদুল হক বলেন, ‘একাত্তরের গণহত্যা বৈশ্বিকভাবে একটি প্রায় বিস্মৃত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, এ নিয়ে নানা দেশে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আর এ ধারা ক্রমে বাড়ছে।’ আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতিও পাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।