নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের নির্যাস

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখছে স্যার জন উইলসন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখছে স্যার জন উইলসন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে। ছবি: প্রথম আলো

এইমাত্র তারা দেখে এসেছে মরণপণ যুদ্ধের দৃশ্য। চোখের সামনে ভাসছে বন্দুক, গোলাবারুদ। মাথার ভেতরে এখনো শব্দ তুলছে যুদ্ধবিমান। এমন মনো-আবহে সামনে এসে দাঁড়ালেন দুই বিজয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রামাণ্যচিত্র দেখার সময় মনে যত প্রশ্ন জেগেছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের, সব যেন ঝাঁক বেঁধে ছুটে গেল তাঁদের উদ্দেশে।

আঙ্কেল, আপনি কী দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, কী ধরনের বন্দুক ছিল, আপনার ভয় করেনি, আপনি কি আহত হয়েছিলেন—এমন অসংখ্য প্রশ্নের জবাব শেষতক মুক্তিযুদ্ধের গল্প হয়ে ডানা মেলে।

গত বুধবার শীতের সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিখা অনির্বাণের সামনে বসল এই গল্প শোনার আসর। শিক্ষার্থীরা সব রাজধানীর স্যার জন উইলসন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদের বিস্ময়মাখা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ বদরে আলম। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন ২ নম্বর সেক্টরে। অপর মুক্তিযোদ্ধা পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী থানার এস এম শাহাবুদ্দিন। তিনি যুদ্ধ করেছেন ৯ নম্বর সেক্টরে। তাঁরা নিজেদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নতুন প্রজন্মের শিশুদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন আর মেটালের তাদের অসীম কৌতূহল।

এটা আসলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ‘আউট রিচ’ কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে আসা হয়। প্রথমে তাদের বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস নামের ২২ মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। জাদুঘরের তৈরি এই প্রামাণ্যচিত্রে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতাসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্র শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে।

এরপর শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় জাদুঘরের প্রদর্শন কক্ষের নিদর্শনগুলো দেখাতে। নতুন ভবনে চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় চারটি কক্ষে সাজানো আছে দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের বহু প্রামাণ্য নিদর্শন, তথ্য-উপাত্ত।

দেখার পর্ব শেষ হলে তারা যা দেখেছে, তার ওপর ভিত্তি করে হয় একটি কুইজ প্রতিযোগিতা। তাতে বিজয়ীর জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও থাকে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই আউট রিচ কর্মসূচি শুরু করেছিল ১৯৯৭ সালে। জাদুঘরের কর্মসূচি সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৮৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২ লাখ ৪০ হাজার ৩৭৯ জন শিক্ষার্থী এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। যেসব স্কুলের নিজস্ব যানবাহন আছে, তারা নিজ ব্যবস্থাপনায় জাদুঘরে আসে। যাদের যানবাহন নেই, জাদুঘরই তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে থাকে। আগে যোগাযোগ করে সব ঠিকঠাক করা হয়।

এ ছাড়া জাদুঘরের দুটো গাড়ি ‘ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর’ হিসেবে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। ‘রিচ-আউট’ নামে এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য সারা দেশের শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর জাতির চিরগৌরবের এই সংগ্রামকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের স্মৃতিতে জীবন্ত করে রাখতে আরও কিছু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। মহানগরীর স্কুলের শিক্ষকদের নিয়ে তারা ‘নেটওয়ার্ক শিক্ষক’ নামের একটি যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। এতে যুক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪২৬ জন শিক্ষক। তাঁরা জাদুঘরের কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে জানেন, খোঁজ রাখেন। শিক্ষার্থীদের নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। এই নেটওয়ার্ক আরও বাড়ানো হবে।

তরুণদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্য আরেকটি উদ্যোগ হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংগ্রহ। শিক্ষার্থীরা তাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বা যাঁরা সরাসরি যুদ্ধ দেখেছেন, তাঁদের মুখ থেকে যুদ্ধের বিবরণ শুনে তারা লিখে পাঠায়। ‘ইতিহাস প্রকল্প’ নামে সংগ্রহ করা এসব ভাষ্যের সত্যতা যাচাই করা হয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে। তারপর সেগুলো সংরক্ষণ করা হয়। এসব তথ্য সংগ্রহকারীকে সনদও দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে এই প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যগুলো পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। এ পর্যন্ত ৬৪ জেলার ৪৯ হাজার ৭২১ জন প্রত৵ ক্ষদর্শীর ভাষ্য সংগৃহীত হয়েছে বলে জানায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এ থেকে যাচাই-বাছাই করে ২৮টি জেলার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য নিয়ে ২৪টি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ২৫ তম পুস্তিকার কাজ চলছে।

শনিবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজনে মিরপুরের ‘জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠ’-এ প্রতি শনিবার আয়োজিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ নামের তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশেষ আয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য বা প্রত্যক্ষদর্শীরা এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। গত সপ্তাহে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার ৩৬৩ তম আসর।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এসব কর্মসূচির উদ্দেশ্য কী, জানতে চাইলে জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাদুঘর প্রতিষ্ঠার একটা বড় লক্ষ্য ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইতিহাসের নির্যাস পৌঁছে দেওয়া। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাদুঘরকে শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা নেই। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য এই আয়োজন করেছে। এটা আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’