ঢাকা উদ্যানে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে প্রায়ই

>
  • যাতায়াতে নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার হয় ছাত্রীরা
  • শঙ্কিত অভিভাবক শিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে দিতে চান না
  • উঠতি বয়সী ছেলেদের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে কোচিং শেষ। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী কোচিংয়ের আরেক সহপাঠীর সঙ্গে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ এক কিশোর এসে মেয়েটিকে পেছন থেকে জাপটে ধরে। সে নিজেকে ছাড়িয়ে বাড়ির পথে দ্রুত পা চালায়।

ঘটনাটি গত নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায়। স্কুলছাত্রীটি প্রথম আলোকে বলে, স্কুল–কোচিংয়ে যাওয়া–আসার পথে প্রতিদিনই হেনস্তার শিকার হতে হয়। আর সন্ধ্যার পরে রাস্তায় চলাচল করলে প্রায়ই যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে।

উঠতি বয়সী ছেলেদের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ। হয়রানির শিকার এক ছাত্রীর ভাষ্য, ‘উত্ত্যক্তকারীদের বয়স ১৬ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তারা দলবদ্ধভাবে থাকে। একজন বাজে মন্তব্য করে বা গায়ে হাত দেয়, বাকিরা হাসাহাসি করে।’ এমনকি স্কুলে মেয়েদের যাতায়াতের দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ এলাকায় মেয়েরা স্কুলে যেতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

ঢাকা উদ্যানের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী মেয়েদের কম–বেশি এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কমপক্ষে ২০ জন ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতেই মেয়েদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। আরেকটু বড় হলেই বাজে প্রস্তাব আসতে শুরু হয়। তা প্রত্যাখ্যান করলে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হতে হয়। তবে সম্প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। এমনকি পথচারীদের সামনেও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। অভিভাবকেরা মেয়েদের ঘর থেকে বের হতে দিতে নিরাপদ বোধ করেন না। কিংবা নিজেরা সঙ্গে করে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যান।

গত অক্টোবরে এলাকার হাজি জয়নাল আবেদিন মার্কেটের পাশের সড়কে এক ছাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে মুঠোফোন নম্বর চায় এক যুবক। নবম শ্রেণির ওই ছাত্রী বিষয়টি পরিবারকে জানালে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে পরিবার। নিপীড়নের শিকার এই ছাত্রীর মা বলেন, ‘মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রাখছি। বাইরেও যাইতে দিই না। চোখে চোখে রাখি।’ এলাকার কাউন্সিলর বা পুলিশকে এ বিষয়ে কেন জানানো হয় না, জানতে চাইলে উত্তরে এই অভিভাবক বলেন, ‘আমরা গরিব। প্রতিবাদ করলে যদি আরও বড় অঘটন ঘটে। তখন দেখার কেউ থাকবে না।’ এই ছাত্রীর বাবা রিকশা চালান, মা গৃহকর্মীর কাজ করেন। মেয়েকে দেখে রাখার জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে নানিকে নিয়ে আসা হয়েছে।

নারী অধিকারকর্মী এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে অভিভাবক জিম্মি হয়ে যায়? মেনে নেওয়ার মানসিকতা পরিহার করে অভিভাবককে প্রতিবাদী হতে হবে। পুলিশ–প্রশাসনকে মেয়েদের এই ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে দায়িত্ব নিতে হবে। তবে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় কাউন্সিলরকে। তিনি এ ধরনের হয়রানির ঘটনায় সরকারি জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯–তে কল করার পরামর্শ দেন।

স্থানীয় মেয়েদের পাশাপাশি অন্য এলাকা থেকে আসা মেয়েরাও হয়রানির শিকার হয়। বেসরকারি সংস্থা সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন তিন বছর ধরে এ এলাকায় একটি স্কুল পরিচালনা করছে। এই স্কুলটিতে পড়াতেন ইডেন মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থী। উত্ত্যক্তের কারণে তিনি কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মুঈনুল ফয়সাল বলেন, এ এলাকায় হয়রানির ঘটনা অনেক বেশি। এ কারণে ইচ্ছা থাকার পরও অনেক নারীশিক্ষক এখানে পড়াতে আসেন না। আবার মেয়েরাও একটু বড় হয়ে গেলে স্কুলে আসে না। তিনি আরও বলেন, বখে যাওয়া তরুণদেরও পরামর্শ (কাউন্সিলিং) দেওয়া যেতে পারে। তাতে কাজ না হলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এসব সমস্যার বিষয়ে কথা বলতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিবকে তাঁর মুঠোফোনে কল দিয়ে এবং খুদে বার্তা দিয়েও যোগাযোগ করা যায়নি।

এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন মীর বলেন, ‘এ এলাকার পরিস্থিতি আগে বেশ খারাপ ছিল। অভিযানের ফলে কিছুটা উন্নত হয়েছে। উত্ত্যক্তের বিষয়ে অভিভাবকদের ভয় ভেঙে অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’