মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নভঙ্গ, বীর নিবাসে ফাটল

অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের দেওয়া লাল-সবুজ রঙের বাড়ি ‘বীর নিবাস’। সম্প্রতি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শুকদেব নগর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের দেওয়া লাল-সবুজ রঙের বাড়ি ‘বীর নিবাস’। সম্প্রতি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শুকদেব নগর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি
  • সারা দেশে ২,৭২০ ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার জন্য ‘বীর নিবাস’ নামে একতলা বাড়ি বানানোর উদ্যোগ নেয় সরকার।
  • বছর না পেরোতেই ভবনের নানা স্থানে ফাটল ধরেছে

লাল-সবুজ রঙে রাঙানো দেয়াল। দেয়ালজুড়ে যেন বাংলাদেশের পতাকারই প্রতিচ্ছবি। বাড়ির সামনে পাথরের নামফলকে লেখা ‘বীর নিবাস’। ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধারা এই বাড়ি পেয়েই খুশিই ছিলেন। কিন্তু বছর না পেরোতেই ভবনের নানা স্থানে ফাটল ধরায় যাঁরা বীর নিবাসে উঠেছিলেন, তাঁরা আতঙ্কে আছেন।

নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করায় অল্প দিনেই সরকারের দেওয়া উপহারটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক ভবনেই পলেস্তারা খসে পড়েছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় জানালা খুলে পড়ছে।

অন্যদিকে বেশির ভাগ জেলায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ঠিকমতো বাছাই করা হয়নি। কোথাও কোথাও সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারাও বাড়ি পেয়েছেন। অনেকের স্বজন এসে সেসব বাড়িতে থাকছেন। কেউ কেউ এসব বাড়িতে তালা দিয়ে নিজের বাড়িতে থাকছেন, কেউ-বা ভাড়া দিয়েছেন।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই সারা দেশে ২ হাজার ৭২০ জন ভূমিহীন ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের পরিবারকে পাকা বাসস্থান নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বীর নিবাস নামের একতলা এই বাড়িগুলোয় দুটি শয়নকক্ষ, একটি প্রশস্ত বারান্দা ও শৌচাগার আছে। শুধু আবাসিক ভবনই নয়, প্রতিটি বাড়িতে গরু, হাঁস, মুরগি পালনের জন্য পৃথক শেড বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে একটি করে নলকূপ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এ রকম ২ হাজার ৯৭১টি বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার কথা। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ৮৫৫টি ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ১ হাজার ৭৪টি ইউনিটের কাজ চলছে। এ ছাড়া ২৭৩টির দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যদিও ২০১৬ সালের মধ্যে সব কাজ শেষ করার কথা ছিল।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে, সেসব ভবন যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁদের আমরা ডেকে বিষয়টি জানতে চাইব। ঠিকাদার বা প্রকৌশলী কার গাফিলতিতে এ অবস্থা, সেটা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ সচ্ছলরা কোনোভাবেই এসব বাড়ি পাওয়ার উপযোগী নন বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।

সম্প্রতি প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, গাজীপুর, জামালপুর ও নোয়াখালীর শতাধিক বীর নিবাস ঘুরে দেখা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, এই বাড়ি তাঁদের আবাসনের কষ্ট দূর করেছিল সত্য, কিন্তু ভবনে ফাটল ধরায়, নিম্নমানের ভবন হওয়ায় এখন তাঁদের মনের ভেতরেও ফাটল ধরেছে। তাঁদের মন ভেঙে গেছে।

বছর না ঘুরতেই ফাটল

মাদারীপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ৩১টি ভবন হস্তান্তরের কয়েক মাসের মধ্যেই ফাটল দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ঝিকরহাটি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ও কেন্দুয়া ইউনিয়নের কাউয়াকুড়ি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আক্কেল আলী আকনের বীর নিবাসে গিয়ে দেখা গেল, ভবনের রং উঠে যাচ্ছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় দরজা-জানালা বাঁকা হয়ে গেছে। রাতে জানালা লাগানো যায় না। নষ্ট হয়ে গেছে নলকূপটিও। ২০টি বীর নিবাসে গিয়ে প্রায় একই চিত্র দেখা গেল।

আক্কেল আলী বলেন, ঠিকাদারেরা ঠিকমতো কাজ করেননি। এ বিষয়ে বেশ কয়েকবার প্রকৌশলীদের কাছে গিয়েছেন তিনি। তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। আবুল কাশেম অভিযোগ করেন, ‘দেয়ালে এমনভাবে ফাটল ধরেছে যে ঘরের মধ্যে থাকতে ভয় পাচ্ছি।’

মাদারীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জ্যেষ্ঠ ডেপুটি কমান্ডার মো. জাহাঙ্গীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, বীর নিবাসগুলোতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় বেশির ভাগ ভবনই এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৯৪টি পাকা বাসস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। চার বছরের মধ্যেই অধিকাংশ বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, বিজয়নগর, সরাইল ও আখাউড়া উপজেলায় ১৫টি বীর নিবাস ঘুরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অধিকাংশ বাসস্থানেই ফাটল দেখা দিয়েছে। সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের খরমপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত হোসেনের স্ত্রী রেহেনা বেগম অভিযোগ করেন, ‘ঠিকাদার কোনোমতে কাজ করেছে। এখানে থাকতে ভয় পাচ্ছি।’

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে তিনটি ও পাশের আলফাডাঙ্গা উপজেলার একটিসহ মোট চারটি বীর নিবাস ঘুরে দেখা হয়েছে। জালিয়াডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা গঞ্জর আলী বলেন, নির্মাণের তিন বছরের মধ্যেই খসে পড়ছে পলেস্তারা।

সচ্ছলরাও পেয়েছেন বীর নিবাস

অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা বীর নিবাস ধনাঢ্যরাও পেয়েছেন। কেউ দিয়েছেন ভাড়া,কারোরটায় অন্য কেউ থাকেন। আবার অনেকের বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ১৪ ডিসেম্বর সকালে জামালপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের বারুয়ামারী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিমের ঘরটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি অসচ্ছল নন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে সরকারি চাকরি করেন। তিনি নিজেও সরকারি চাকুরে ছিলেন। ঘরটিতেও তিনি থাকেন না। তিনি থাকেন জামালপুর পৌর শহরে। ঘরে থাকেন তাঁর মেয়ে রায়েরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কাশপে হাসনা ওরফে কনা। তবে বাড়িতে কাউকেই পাওয়া যায়নি।

একই উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম বলেন, তাঁর ঘরটিও জরাজীর্ণ। তিনি ঘর পাননি। প্রতিটি ঘর পেতে তদবির ও টাকা দিতে হয়েছে। যেসব মুক্তিযোদ্ধা ধনী তাঁরা সব দিক থেকে এগিয়ে রয়েছেন। ফলে তাঁরাই এসব ঘর পাচ্ছেন। কেন্দুয়া ইউনিয়নের কলতাপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুর ছবুরও একটি ঘর পেয়েছেন। তাঁর বড় ছেলে জাকির হোসেন বলেন, এক বছর আগে ঘরটি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু ঘরখানি পেতে প্রায় দেড় লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

বীর নিবাস পেয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ধীরাশ্রম এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আলী। বাজারে তাঁর ১০টি দোকান আছে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার জৈনসার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. সাজাহানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তাঁর নিজের বাড়ি, পুকুরসহ ১০ শতক জমি আছে। চার ছেলের মধ্যে তিনজনই সরকারি চাকরি করেন। প্রকল্পের নীতিমালায় বলা আছে, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বলতে বোঝাবে, যাঁদের ৮ শতাংশের বেশি জমি নেই এবং সংসারে আয় করার মতো সক্ষম সন্তান নেই।

তবু শেষ বয়সে স্বস্তি

নোয়াখালীর নয়টি উপজেলার ৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে গত চার বছরে বীর নিবাস তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা বেশ খুশি এমন একটি বাড়ি পেয়ে। সম্প্রতি কথা হয় সেনবাগের বিষ্ণুপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পৈতৃক ভিটেমাটি যা কিছু ছিল তার বেশির ভাগই বিক্রি করতে হয়েছে সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে। তাই ভালো একটি ঘরও তৈরি করা হয়ে ওঠেনি। তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি জীবনের শেষ বয়সে এমন একটা বাড়ি পাবেন।

বীর নিবাস পেয়েছেন একই উপজেলার নজরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদের স্ত্রী জাহানারা বেগম ও সদর উপজেলার নেওয়াজপুর ইউনিয়নের সাহাপুর গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফাও। তাঁদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হিসেবে সরকারের এই উপহার সমাজে তাঁদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা সহায়তা করেছেন]